শিলাজিৎ, যা সোনালি রঙের আঠালো পদার্থ হিসেবে পরিচিত, এটি একটি প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থ যা হিমালয় পর্বত থেকে সংগৃহীত হয়। এটি শত শত বছর ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এর প্রাকৃতিক ওষুধি গুণাগুণের জন্য খুবই জনপ্রিয়। শিলাজিৎ এর উৎপত্তি মূলত পাহাড়ের গুহায় ও শিলার ফাঁকে জমা হওয়া প্রাকৃতিক খনিজ উপাদানগুলোর মিশ্রণ থেকে।

শিলাজিৎ এর পুষ্টিগুণ:

শিলাজিৎ এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর প্রধান পুষ্টিগুণ গুলো হলো:

  • ফুলভিক অ্যাসিড: শিলাজিৎ এর প্রধান উপাদান ফুলভিক অ্যাসিড, যা শরীরের কোষগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় অন্যতম কার্যকরী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
  • মিনারেলস বা খনিজ পদার্থ: শিলাজিৎ এ ৮৫ এরও বেশি খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খনিজ পদার্থগুলো শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে, হাড়ের গঠন মজবুত করতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: শিলাজিৎ এর মধ্যে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের ফ্রি র‌্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে। এছাড়া, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষগুলোকে সুরক্ষা দেয় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
  • ইনফ্লামেশন রোধকারী উপাদান: শিলাজিৎ এর মধ্যে প্রাকৃতিক ইনফ্লামেশন রোধকারী উপাদান রয়েছে, যা শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। এটি আথ্রাইটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর।
  • এনার্জি বুস্টার: শিলাজিৎ শরীরের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। এটি শরীরের মাইটোকন্ড্রিয়াকে সক্রিয় করে, যা দেহের কোষগুলোতে শক্তি উৎপন্ন করে। ফলে শারীরিক এবং মানসিক ক্লান্তি দূর করতে এটি বিশেষভাবে কার্যকর।
  • হরমোন ব্যালেন্সার: শিলাজিৎ হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। এটি বিশেষ করে পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
  • মানসিক সুস্থতা: শিলাজিৎ এর মধ্যে মানসিক চাপ কমানোর উপাদান রয়েছে। এটি মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করতে সহায়ক।

শিলাজিৎ খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা

নিয়মিত শিলাজিৎ খাওয়ার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে উপকার পাওয়া যায়। এখানে আমরা এর কিছু প্রধান স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করবো।

১. শক্তি বৃদ্ধি

শিলাজিৎ খেলে শরীরে প্রাকৃতিকভাবে শক্তির স্তর বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে থাকা ফুলভিক অ্যাসিড শরীরের মাইটোকন্ড্রিয়া সক্রিয় করে, যা কোষগুলোতে শক্তি উৎপাদন করে। ফলে শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর হয় এবং সারাদিন প্রাণবন্ত থাকা যায়।

২. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

শিলাজিৎ এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি শরীরের ফ্রি র‌্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে কোষগুলোকে রক্ষা করে, ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

৩. হাড় ও সংযোজক কলার শক্তি বৃদ্ধি

শিলাজিৎ এর মধ্যে থাকা খনিজ পদার্থগুলো হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং সংযোজক কলার শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য খুবই উপকারী, যাদের হাড়ের গঠন দুর্বল হতে থাকে।

৪. হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা

শিলাজিৎ পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, যা হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, এটি অন্যান্য হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক।

৫. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি

শিলাজিৎ নিয়মিত খেলে মানসিক চাপ কমে এবং মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে থাকা প্রাকৃতিক উপাদানগুলো মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, যার ফলে মনোযোগের ঘাটতি, উদ্বেগ এবং ডিপ্রেশন কমে যায়।

৬. এন্টি-ইনফ্লামেটরি প্রভাব

শিলাজিৎ এর মধ্যে প্রাকৃতিক এন্টি-ইনফ্লামেটরি উপাদান রয়েছে, যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি আরথ্রাইটিস বা অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মতো সমস্যা সমাধানে সহায়ক।

৭. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস

শিলাজিৎ এ থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি শরীরের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এটি শরীরের কোষগুলোকে সুরক্ষিত রাখে এবং বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার প্রতিরোধে সাহায্য করে।

৮. হজমশক্তি উন্নত করা

শিলাজিৎ হজমশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি খাবারের পুষ্টিগুণ ভালোভাবে শরীরে শোষিত করতে সহায়ক, ফলে শরীরের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হয় এবং সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

বয়সভেদে শিলাজিৎ খাওয়ার পরিমান

শিলাজিৎ এর উপকারিতা পেতে হলে সঠিক পরিমাণে এবং নির্দিষ্ট বয়সের প্রয়োজন অনুসারে এটি গ্রহণ করা উচিত। এখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য শিলাজিৎ খাওয়ার উপযুক্ত পরিমাণ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক (১৮-৫০ বছর):

এই বয়সের মানুষদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সাধারণত, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম শিলাজিৎ খাওয়া যেতে পারে। এটি শরীরে শক্তি বাড়ায়, হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক।

২. বয়স্ক ব্যক্তিরা (৫০ বছর থেকে ঊর্ধ্ব):

বয়স্কদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কম হওয়া উচিত, কারণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। সাধারণত, ৫০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্কদের জন্য প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম শিলাজিৎ যথেষ্ট। এটি হাড়ের গঠন মজবুত রাখতে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে সহায়ক।

৩. যুবতী ও মহিলারা:

মহিলাদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়ার পরিমাণ পুরুষদের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। সাধারণত, মহিলাদের জন্য প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ মিলিগ্রাম শিলাজিৎ গ্রহণ করা যেতে পারে। এটি হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে, মানসিক চাপ কমায় এবং শারীরিক শক্তি বাড়ায়।

৪. কিশোর-কিশোরী (১৩-১৮ বছর):

কিশোর-কিশোরীদের শরীরে শিলাজিৎ প্রয়োজনীয় হলেও, এটি খুব কম পরিমাণে দেওয়া উচিত। সাধারণত, প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ মিলিগ্রাম শিলাজিৎ এই বয়সের জন্য যথেষ্ট। এটি হাড়ের গঠন মজবুত রাখতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।

৫. শিশু (১৩ বছরের নিচে):

শিশুদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়া একেবারেই উচিত না। তাদের শরীরের জন্য শিলাজিৎ উপযুক্ত নয় এবং এটি তাদের শরীরে অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে শিলাজিৎ খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

কখন শিলাজিৎ খাওয়া উচিত

শিলাজিৎ খাওয়ার সঠিক সময়টি নির্ভর করে আপনার শারীরিক অবস্থা এবং লক্ষ্যগুলোর উপর। সাধারণত, এটি খালি পেটে সকালে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী, কারণ এটি শরীরের শক্তি বৃদ্ধি এবং সারা দিন কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এছাড়াও, রাতে ঘুমানোর আগে শিলাজিৎ খাওয়া যেতে পারে, যা শরীরের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

কিভাবে শিলাজিৎ খাওয়া উচিত

শিলাজিৎ খাওয়ার সঠিক পদ্ধতি এবং পরিমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, শিলাজিৎকে পানিতে গুলিয়ে বা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়। নিচে কিছু উপায় দেওয়া হলো:

  • পানিতে মিশিয়ে: ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম শিলাজিৎ ১ কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি খালি পেটে সকালে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী।
  • দুধের সাথে মিশিয়ে: শিলাজিৎ দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হলে এটি শরীরে দ্রুত শোষিত হয় এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি রাতে ঘুমানোর আগে খাওয়া যেতে পারে।
  • মধুর সাথে মিশিয়ে: শিলাজিৎকে মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া খুবই কার্যকরী, কারণ মধু শিলাজিৎ এর পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে তোলে এবং এটি হজমে সহায়ক হয়।

কোন কোন উপাদানের সাথে শিলাজিৎ খাওয়া উচিত

শিলাজিৎ সাধারণত গরম পানিতে, দুধে, বা মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়। এ ধরনের উপাদানগুলি শিলাজিৎ এর পুষ্টিগুণ ভালোভাবে শোষিত হতে সাহায্য করে এবং এর উপকারিতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া, কিছু ভেষজ উপাদানের সাথেও শিলাজিৎ মিশিয়ে খাওয়া যায়, যেমন অশ্বগন্ধা, গোকুরু, বা শাতাবারী, যা শারীরিক ও মানসিক শক্তি বাড়াতে সহায়ক।

কখন এবং কেন শিলাজিৎ খাওয়া উচিত না

শিলাজিৎ অত্যন্ত কার্যকরী হলেও, এটি সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিস্থিতিতে না খেলে ক্ষতিকর হতে পারে। নিচে কিছু পরিস্থিতি উল্লেখ করা হলো যখন শিলাজিৎ খাওয়া উচিত নয়:

  • হাইপোথাইরয়েডিজম: যাদের হাইপোথাইরয়েডিজম রয়েছে, তাদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়া সুপারিশ করা হয় না, কারণ এটি হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
  • গর্ভাবস্থা ও স্তন্যদানকালীন সময়: গর্ভবতী মহিলারা এবং যারা স্তন্যদান করছেন তাদের জন্য শিলাজিৎ খাওয়া নিষেধ। এটি শারীরিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
  • হাইপারটেনশন: উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের শিলাজিৎ খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি রক্তচাপ বাড়াতে পারে।
  • ডায়াবেটিস: শিলাজিৎ রক্তে শর্করার স্তর হ্রাস করতে পারে, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এটি গ্রহণ করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • অ্যালার্জি বা প্রতিক্রিয়া: যাদের শিলাজিৎ এর প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের এটি খাওয়া একেবারেই উচিত নয়।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 25, 2024