শতমূলী, যার বৈজ্ঞানিক নাম Asparagus Racemosus, একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ুর্বেদিক ঔষধি উদ্ভিদ। এটি সাধারণত ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং হিমালয়ের অঞ্চলগুলোতে পাওয়া যায়। শতমূলী শব্দের অর্থ “শত মূলে ভরা,” অর্থাৎ এটি অনেকগুলো মূল সহ একটি উদ্ভিদ। এটি মূলত তার শিকড়ের জন্য পরিচিত, যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
শতমূলীর শিকড় গুঁড়া বা ক্যাপসুল আকারে পাওয়া যায় এবং এটি নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
শতমূলীর পুষ্টিগুণ:
১. প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: শতমূলীতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যালস থেকে রক্ষা করে। এটি কোষের ক্ষয়ক্ষতি কমায় এবং বার্ধক্য রোধে সহায়ক।
২. ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে: শতমূলী ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং শরীরের সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে উপস্থিত স্যাপোনিনস নামক যৌগ শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে।
৩. হরমোন ব্যালেন্সে সহায়ক: নারীদের জন্য শতমূলী বিশেষভাবে উপকারী, কারণ এটি হরমোন ব্যালেন্স বজায় রাখতে সাহায্য করে। ঋতুস্রাবের সমস্যায় বা মেনোপজের সময় এটি কার্যকর হতে পারে।
৪. দুধ উৎপাদন বাড়ায়: যেসব মা সন্তানকে দুধ পান করান, তাদের জন্য শতমূলী অত্যন্ত উপকারী। এটি স্তন দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, যা নবজাতকের পুষ্টি নিশ্চিত করে।
৫. দৈহিক শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি: শতমূলী শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা বাড়াতে সহায়ক। এটি দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৬. পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী: শতমূলী পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাগুলো কমাতে সাহায্য করে।
নিয়মিত শতমূলী খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা
শতমূলী, যা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ঔষধি উদ্ভিদ, প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিকারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই উদ্ভিদের শিকড় থেকে প্রাপ্ত উপাদানগুলোর মধ্যে এমন কিছু পুষ্টিগুণ রয়েছে যা শরীরকে সুস্থ এবং সতেজ রাখতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নেওয়া যাক নিয়মিত শতমূলী খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলো:
১. হরমোন ব্যালেন্স বজায় রাখা:
শতমূলী বিশেষত নারীদের জন্য খুবই উপকারী, কারণ এটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক। ঋতুস্রাবের সময় এবং মেনোপজের আগে এবং পরে হরমোনের পরিবর্তনজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে শতমূলী কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি হরমোনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে।
২. প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি:
শতমূলী প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি প্রজনন অঙ্গগুলির স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক এবং নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য প্রজনন সমস্যা সমাধানে কার্যকর। শতমূলী বিশেষত মহিলাদের গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে এবং পুরুষদের স্পার্মের গুণমান উন্নত করতে পারে।
৩. ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা:
শতমূলী ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, যা শরীরকে নানা ধরনের সংক্রমণ ও রোগ থেকে রক্ষা করে। এতে থাকা স্যাপোনিনস নামক যৌগ শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফলে আপনি সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন না।
৪. মানসিক চাপ কমানো:
শতমূলী মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক। এটি একটি প্রাকৃতিক এডাপ্টোজেন, যা শরীরকে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। নিয়মিত শতমূলী সেবন মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং ভাল ঘুম নিশ্চিত করতে পারে।
৫. হজমশক্তি উন্নত করা:
শতমূলী হজমশক্তি বাড়াতে সহায়ক। এটি পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক এবং অ্যাসিডিটির মতো সমস্যা থেকে রেহাই দেয়। শতমূলীর শিকড়ে উপস্থিত স্টেরয়েড স্যাপোনিনস হজমে সহায়ক এনজাইমের উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
৬. শারীরিক শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি:
শতমূলী নিয়মিত সেবনে শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এটি দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ক্লান্তি দূর করে এবং আপনাকে আরও কর্মক্ষম রাখে। বিশেষত যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন, তাদের জন্য শতমূলী একটি দুর্দান্ত টনিক হিসেবে কাজ করতে পারে।
৭. স্তন্যপানকারী মায়েদের জন্য উপকারী:
শতমূলী মায়েদের স্তন দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যারা নবজাতককে স্তন দুধ পান করান, তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী। শতমূলী দুধের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করে।
বয়সভেদে শতমূলী খাওয়ার পরিমান
সঠিক পরিমাণে শতমূলী গ্রহণ করলে এর পুষ্টিগুণগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। চলুন জেনে নিই কোন বয়সের মানুষের কতটুকু শতমূলী খাওয়া উচিত:
১. বাচ্চাদের জন্য (৫-১২ বছর):
শিশুদের ক্ষেত্রে শতমূলী সাধারণত সরাসরি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি বা হজমের উন্নতি করতে, একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে খুবই সামান্য পরিমাণ শতমূলী ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত ৫-১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শতমূলী গুঁড়ার পরিমাণ ১/৪ চা চামচের কম হওয়া উচিত। অবশ্যই, এটি একজন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দেওয়া উচিত নয়।
২. কিশোর-কিশোরীদের জন্য (১৩-১৮ বছর):
এই বয়সে শতমূলী গ্রহণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। হরমোন ব্যালেন্স এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে শতমূলী সাহায্য করতে পারে। তবে, দৈনিক ১/২ চা চামচের বেশি শতমূলী গুঁড়া কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজন হয় না। এর বেশি পরিমাণে গ্রহণ হরমোনে প্রভাব ফেলতে পারে, তাই পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য (১৯-৫০ বছর):
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শতমূলী গ্রহণের উপযুক্ত সময়। বিশেষ করে যারা মানসিক চাপ, হরমোনজনিত সমস্যা বা পাচন সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য শতমূলী অত্যন্ত কার্যকর। এই বয়সে, দিনে ১ চা চামচ শতমূলী গুঁড়া খাওয়া যেতে পারে। এটি দুধ বা জল দিয়ে খাওয়া যেতে পারে, এবং দিনের যে কোনো সময়ে গ্রহণ করা যায়, তবে খাওয়ার পরে সেবন করা ভালো।
৪. বয়স্কদের জন্য (৫০ বছরের ঊর্ধ্বে):
বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য শতমূলী আরও উপকারী হতে পারে, কারণ এটি হাড়ের স্বাস্থ্য, ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। তবে, এই বয়সে শতমূলীর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিনে ১/২ চা চামচ শতমূলী গুঁড়া খাওয়া যথেষ্ট। যারা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের মতো সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
কখন শতমূলী খাওয়া উচিত
১. সকালে খাওয়ার পর: শতমূলী খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো সকালে খাওয়ার পরে। এটি হজমে সহায়তা করে এবং সারাদিনের শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। সকালে খাওয়ার পর শতমূলী গ্রহণ করলে এটি শরীরে দ্রুত শোষিত হয় এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।
২. বিকেলে বা রাতে: যারা মানসিক চাপ বা অনিদ্রায় ভুগছেন, তাদের জন্য বিকেল বা রাতের খাবারের পরে শতমূলী গ্রহণ করা ভালো। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং ভালো ঘুম নিশ্চিত করে।
কিভাবে শতমূলী খাওয়া উচিত
১. গুঁড়া আকারে: শতমূলী সাধারণত গুঁড়া আকারে পাওয়া যায়, যা দুধ বা জল দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। দিনে ১ চা চামচ শতমূলী গুঁড়া এক গ্লাস দুধ বা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
২. ক্যাপসুল আকারে: যারা গুঁড়া আকারে শতমূলী খেতে অসুবিধা বোধ করেন, তারা ক্যাপসুল আকারেও শতমূলী গ্রহণ করতে পারেন। প্রতিদিন সকালে বা রাতে একটি ক্যাপসুল গ্রহণ করা যেতে পারে।
কোন কোন উপাদানের সাথে শতমূলী খাওয়া উচিত
১. দুধের সাথে: শতমূলী দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া সবচেয়ে উপকারী। দুধ শতমূলীর কার্যকারিতা বাড়ায় এবং এটি শরীরের শোষণ প্রক্রিয়াকে সহজতর করে। এটি বিশেষত নারীদের হরমোন ব্যালেন্স বজায় রাখতে সহায়ক।
২. মধুর সাথে: শতমূলীর তিক্ততা কমাতে মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। মধু শতমূলীর প্রভাবকে আরও বৃদ্ধি করে এবং এটি গ্রহণ করা সহজ করে তোলে।
৩. ঘি এর সাথে: ঘি একটি প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। শতমূলী ঘি এর সাথে মিশিয়ে খেলে এটি হজমে সহায়ক হয় এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ শোষণ প্রক্রিয়া উন্নত করে।
কখন শতমূলী খাওয়া উচিত নয়
১. গর্ভাবস্থায়: গর্ভবতী মহিলাদের শতমূলী খাওয়ার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিছু ক্ষেত্রে শতমূলী গর্ভের শিশুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তাই সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
২. অন্ত্রের সমস্যা বা আলসার থাকলে: যারা অন্ত্রের সমস্যা, যেমন আলসার বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য শতমূলী গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শতমূলী কিছু ক্ষেত্রে অন্ত্রের সমস্যা বাড়াতে পারে।
৩. অতিরিক্ত পরিমাণে: শতমূলী অত্যন্ত উপকারী হলেও, অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, বা পেটের সমস্যা। তাই পরিমিত পরিমাণে শতমূলী গ্রহণ করা উচিত।