যষ্টিমধু, যাকে ইংরেজিতে ‘Licorice’ বলা হয়, একটি প্রাকৃতিক ভেষজ যা দীর্ঘদিন ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি মূলত যষ্টিমধু গাছের শিকড় থেকে প্রাপ্ত হয়। এই গাছটি সাধারণত ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যায়। যষ্টিমধু প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যেমন গলা ব্যথা, হজমের সমস্যা, কাশি ইত্যাদি।

যষ্টিমধুর পুষ্টিগুণ

যষ্টিমধুতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুষ্টিগুণ হলো:

  • গ্লাইসিরাইজিন: যষ্টিমধুর প্রধান উপাদান হলো গ্লাইসিরাইজিন, যা এর স্বাদকে মিষ্টি করে তোলে। এই উপাদানটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
  • ফ্ল্যাভোনয়েডস: যষ্টিমধুতে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনয়েডস থাকে, যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
  • ভিটামিন ও খনিজ: যষ্টিমধুতে প্রচুর ভিটামিন বি এবং খনিজ যেমন পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে এবং হাড়কে মজবুত রাখতে সহায়ক।
  • অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব: যষ্টিমধুতে থাকা বিভিন্ন উপাদানগুলি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত গলা ব্যথা, আর্থ্রাইটিস, এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
  • হজমে সহায়ক: যষ্টিমধু হজমের প্রক্রিয়াকে উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি বদহজম, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং অম্বলের মতো সমস্যার সমাধানে কার্যকর।

নিয়মিত যষ্টিমধু খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা

যষ্টিমধু বা লিকোরিস এমন একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। নিয়মিত যষ্টিমধু সেবন করলে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর হয় এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। নিচে যষ্টিমধুর নিয়মিত সেবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য উপকারিতা আলোচনা করা হলো:

১. গলা ব্যথা ও কাশি উপশমে সহায়ক

যষ্টিমধু প্রাকৃতিকভাবে গলা ব্যথা ও কাশি নিরাময়ে কার্যকরী। এর মধ্যে থাকা গ্লাইসিরাইজিন উপাদানটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা গলা ব্যথা এবং কাশি কমায়। নিয়মিত যষ্টিমধু খেলে সর্দি-কাশি ও গলা ব্যথার ঝুঁকি কমে যায়।

২. হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে

যষ্টিমধু হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি বদহজম, গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং অম্বলের মতো সমস্যাগুলির সমাধানে সাহায্য করে। যাদের হজমের সমস্যা আছে, তাদের জন্য নিয়মিত যষ্টিমধু খাওয়া বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।

৩. প্রদাহ কমায়

যষ্টিমধুতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানগুলি শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এটি আর্থ্রাইটিস, গলা ব্যথা, এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উপকারী হতে পারে।

৪. ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে

যষ্টিমধুতে থাকা বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফ্ল্যাভোনয়েড উপাদানগুলি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। নিয়মিত যষ্টিমধু খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।

৫. ত্বকের যত্নে সহায়ক

যষ্টিমধুর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদানগুলি ত্বকের জন্যও উপকারী। এটি ত্বকের প্রদাহ কমায় এবং ত্বককে উজ্জ্বল ও কোমল রাখে। বিশেষ করে, ব্রণ বা ত্বকের অন্যান্য সমস্যায় যষ্টিমধু উপকারী হতে পারে।

৬. স্ট্রেস ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে

যষ্টিমধুতে থাকা অ্যাডাপ্টোজেনিক উপাদানগুলি মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সহায়ক। নিয়মিত যষ্টিমধু খেলে মানসিক চাপ কমে এবং মনের শান্তি বজায় থাকে। এটি ঘুমের মান উন্নত করতেও সাহায্য করতে পারে।

৭. শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিরাময়ে সহায়ক

যষ্টিমধু শ্বাসকষ্টের সমস্যা যেমন অ্যাজমা বা ব্রঙ্কাইটিস নিরাময়ে সহায়ক হতে পারে। এটি শ্বাসনালীর প্রদাহ কমাতে এবং শ্বাসনালীর পেশিগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে, যা শ্বাসকষ্ট কমাতে কার্যকরী।

বয়সভেদে যষ্টিমধু খাওয়ার পরিমান

যষ্টিমধু একটি প্রাকৃতিক ভেষজ যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তবে, যষ্টিমধু খাওয়ার ক্ষেত্রে বয়স অনুযায়ী পরিমাণের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত। কারণ, বয়সভেদে শরীরের চাহিদা এবং সহনশীলতা ভিন্ন হতে পারে। নিচে বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য যষ্টিমধুর সঠিক পরিমাণ নিয়ে আলোচনা করা হলো:

শিশুদের জন্য (৫-১২ বছর)

শিশুদের শরীর এই বয়সে বিকাশ ঘটে, তাই তাদের ক্ষেত্রে যষ্টিমধু খাওয়ার পরিমাণ খুবই কম হওয়া উচিত। সাধারণত, ৫-১২ বছরের শিশুদের দিনে এক চিমটি যষ্টিমধু পাউডার বা আধা চামচ যষ্টিমধুর শিকড় চিবিয়ে খাওয়া যথেষ্ট। এটি শিশুদের সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা এবং হজমের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করতে পারে।

কিশোর-কিশোরীদের জন্য (১৩-১৮ বছর)

কিশোর-কিশোরীদের জন্য যষ্টিমধুর পরিমাণ কিছুটা বেশি হতে পারে। এই বয়সের গ্রুপের জন্য দিনে ১ থেকে ১.৫ চা চামচ যষ্টিমধু পাউডার বা শিকড় খাওয়া যেতে পারে। এটি তাদের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে এবং শারীরিক ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য (১৯-৫৯ বছর)

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে যষ্টিমধুর পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়ানো যায়। সাধারণত, দিনে ২ চা চামচ যষ্টিমধু পাউডার বা শিকড় সেবন করা যেতে পারে। এটি হজমের প্রক্রিয়া উন্নত করবে, প্রদাহ কমাবে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হবে। তবে, যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য যষ্টিমধু সেবনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

বয়স্কদের জন্য (৬০ বছর ও তার উপরে)

বয়স্কদের ক্ষেত্রে যষ্টিমধু সেবনের পরিমাণ কম রাখা উচিত। তাদের শরীর অনেক সময় নাজুক হয়ে পড়ে, তাই অতিরিক্ত যষ্টিমধু সেবনে শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে। এ কারণে, বয়স্করা দিনে আধা চা চামচ যষ্টিমধু পাউডার বা সামান্য পরিমাণ শিকড় চিবিয়ে খেতে পারেন। এটি তাদের হজম, শ্বাসকষ্ট, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে।

কখন যষ্টিমধু খাওয়া উচিত

১. সকালবেলা খালি পেটে: সকালে খালি পেটে যষ্টিমধু সেবন করলে এটি শরীরের হজমশক্তি বাড়ায় এবং গলা ব্যথা বা কাশি থেকে মুক্তি দেয়। এটি সর্দি-কাশির সমস্যা কমাতে এবং শরীরকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

২. বিকেলের দিকে: বিকেলে খাবার পর যষ্টিমধু খেলে এটি খাবার হজমে সহায়ক হয়। এতে বদহজম বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কমে এবং শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা বজায় থাকে।

৩. রাতে শোবার আগে: রাতে শোবার আগে যষ্টিমধু খেলে এটি ঘুমের মান উন্নত করে এবং মানসিক চাপ কমায়। যাদের নিদ্রাহীনতার সমস্যা আছে, তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।

কিভাবে যষ্টিমধু খাওয়া উচিত

১. পানি বা দুধের সাথে: যষ্টিমধু পাউডারকে গরম পানি বা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি হজমশক্তি বাড়ায় এবং শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।

২. মধুর সাথে মিশিয়ে: মধুর সাথে যষ্টিমধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি কাশি এবং গলা ব্যথার দ্রুত উপশমে সহায়ক।

৩. তুলসী পাতার রসের সাথে: তুলসী পাতার রসের সাথে যষ্টিমধু মিশিয়ে খেলে এটি সর্দি-কাশির উপশমে কার্যকরী হয়। এটি শ্বাসকষ্টের সমস্যাও কমাতে পারে।

কোন কোন উপাদানের সাথে যষ্টিমধু খাওয়া উচিত

১. আদা: আদার রসের সাথে যষ্টিমধু মিশিয়ে খেলে এটি ঠান্ডা-কাশি এবং হজমের সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে।

২. কালোজিরা: কালোজিরার সাথে যষ্টিমধু মিশিয়ে খেলে এটি ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে এবং শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

৩. গোলমরিচ: গোলমরিচের সাথে যষ্টিমধু মিশিয়ে খেলে এটি গলা ব্যথা এবং কাশির দ্রুত উপশমে কার্যকর।

কখন এবং কেন যষ্টিমধু খাওয়া উচিত না

১. গর্ভাবস্থায়: গর্ভবতী মহিলাদের যষ্টিমধু সেবন থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটি হরমোনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং গর্ভাবস্থার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

২. উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে: যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের যষ্টিমধু সেবন করা উচিত নয়, কারণ এটি রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে।

৩. কিডনি সমস্যার ক্ষেত্রে: যাদের কিডনি সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্য যষ্টিমধু ক্ষতিকারক হতে পারে, কারণ এটি শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়াতে পারে, যা কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

৪. দীর্ঘমেয়াদী সেবন: দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিদিন যষ্টিমধু সেবন করা উচিত নয়। এর ফলে শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 24, 2024