অশ্বগন্ধা (Ashwagandha) হলো একটি প্রচলিত আয়ুর্বেদিক ঔষধি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Withania somnifera। এটি ভারতীয় উপমহাদেশে বহু বছর ধরে ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অশ্বগন্ধা শব্দের অর্থ “ঘোড়ার গন্ধ,” যা গাছের মূলের গন্ধের কারণে এই নামকরণ হয়েছে। এটি শুধু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় নয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে।

অশ্বগন্ধার পুষ্টিগুণ

১. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ: অশ্বগন্ধা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষগুলোকে ফ্রি র‍্যাডিকালসের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে, যা শরীরের বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

২. অ্যাডাপ্টোজেনিক বৈশিষ্ট্য: অশ্বগন্ধার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি অ্যাডাপ্টোজেন। এটি শরীরের মানসিক ও শারীরিক চাপ কমাতে সহায়ক। এটি কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা চাপের সময় বৃদ্ধি পায়।

৩. ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে: অশ্বগন্ধা ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করতে সাহায্য করে। এটি সাদা রক্তকণিকার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে, যা শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

৪. হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে: বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে, অশ্বগন্ধা হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (PCOS) এবং মেনোপজ সম্পর্কিত সমস্যাগুলিতে সহায়ক হতে পারে।

৫. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে: অশ্বগন্ধা স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং শিখনক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। এটি নিউরোট্রান্সমিটারগুলির কার্যকারিতা বাড়িয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে।

৬. উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমায়: অশ্বগন্ধা প্রাকৃতিকভাবে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কমাতে সাহায্য করে। এটি সেরোটোনিন এবং ডোপামিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা মেজাজ উন্নত করতে সহায়ক।

৭. শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করে: অশ্বগন্ধা শরীরের শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি পেশির ভোলাটাইলিটি বাড়িয়ে শরীরের ক্লান্তি কমায় এবং স্ট্যামিনা বৃদ্ধি করে।

৮. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে: অশ্বগন্ধা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারে।

৯. হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: অশ্বগন্ধা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হতে পারে।

বয়সভেদে অশ্বগন্ধার পরিমাণ

অশ্বগন্ধা, যা আয়ুর্বেদিক ঔষধ হিসেবে সুপরিচিত তাই এটি সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত বয়সের সাথে সাথে এর পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। এখানে বয়সভেদে অশ্বগন্ধা গ্রহণের পরিমাণ নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. শিশু ও কিশোরদের জন্য (৫-১৮ বছর):

  • পরিমাণ: শিশু ও কিশোরদের ক্ষেত্রে অশ্বগন্ধা খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। এই বয়সের শিশুদের জন্য দৈনিক মাত্র ২৫০-৫০০ মিলিগ্রাম অশ্বগন্ধা যথেষ্ট হতে পারে।
  • কারণ: এই বয়সে শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রক্রিয়া চলমান থাকে, এবং অশ্বগন্ধা তাদের মানসিক চাপ কমাতে ও ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। তবে, শিশুরা যাতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন না হয়, তা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

২. তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য (১৮-৪০ বছর):

  • পরিমাণ: তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৫০০-১০০০ মিলিগ্রাম অশ্বগন্ধা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • কারণ: এই বয়সের মানুষদের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং কর্মব্যস্ত জীবনের কারণে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অশ্বগন্ধা এসব সমস্যা মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকরী। এটি শরীরের শক্তি, সহনশীলতা ও মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৩. মধ্যবয়স্কদের জন্য (৪০-৬০ বছর):

  • পরিমাণ: এই বয়সের মানুষদের জন্য ১০০০-১৫০০ মিলিগ্রাম অশ্বগন্ধা প্রতিদিন নেওয়া যেতে পারে।
  • কারণ: এই সময়ে শরীরে বার্ধক্যের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। অশ্বগন্ধা এই বয়সের মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, এবং হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা দিতে কার্যকরী।

৪. বয়স্কদের জন্য (৬০ বছর ও তার বেশি):

  • পরিমাণ: বয়স্কদের জন্য ৫০০-৭৫০ মিলিগ্রাম অশ্বগন্ধা প্রতিদিন যথেষ্ট হতে পারে।
  • কারণ: বার্ধক্যে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। অশ্বগন্ধা শরীরকে শক্তি যোগাতে, মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে, এবং বার্ধক্যের প্রক্রিয়া ধীর করতে সাহায্য করে। তবে, এই বয়সে ওষুধের মাত্রা কম রাখা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শে অশ্বগন্ধা গ্রহণ করা উচিত।

কখন অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত

১. সকালে খালি পেটে

সকালে খালি পেটে অশ্বগন্ধা গ্রহণ করলে এটি দ্রুত শরীরে শোষিত হয় এবং শরীরকে পুরোদিনের জন্য শক্তি দেয়। এছাড়া এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং দিন শুরু করার জন্য মনকে প্রফুল্ল রাখে।

২. রাতে শোয়ার আগে

রাতে শোয়ার আগে অশ্বগন্ধা খাওয়া ভালো ঘুম নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এটি মানসিক চাপ কমায়, স্নায়ুকে শিথিল করে, এবং ঘুমের মান উন্নত করে।

কিভাবে অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত

১. গুঁড়ো আকারে

অশ্বগন্ধার গুঁড়ো দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। দুধ অশ্বগন্ধার সাথে মিশে শরীরে দ্রুত শোষিত হয় এবং এর কার্যকারিতা বাড়ায়। এটি শরীরকে পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করে এবং মানসিক স্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।

২. ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট আকারে

অশ্বগন্ধার ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট আকারে গ্রহণ করা যেতে পারে, যা সহজেই পাওয়া যায় এবং সঠিক মাত্রায় গ্রহণ নিশ্চিত করে। যারা গুঁড়ো আকারে গ্রহণ করতে অস্বস্তি বোধ করেন, তাদের জন্য ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট একটি ভালো বিকল্প। এটি গ্রহণ করা সহজ এবং শরীরে সঠিকভাবে কাজ করে।

কোন কোন উপাদানের সাথে অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত

১. দুধ: – দুধের সাথে অশ্বগন্ধা খেলে এটি শরীরে দ্রুত শোষিত হয় এবং তার কার্যকারিতা বাড়ায়। দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া অশ্বগন্ধার গুণাগুণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

২. মধু: – মধুর সাথে অশ্বগন্ধা খাওয়া শরীরে প্রাকৃতিক শক্তি যোগায় এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। মধু অশ্বগন্ধার তিক্ততা কমিয়ে এর স্বাদ উন্নত করে।

৩. ঘি: – ঘি অশ্বগন্ধার কার্যকারিতা বাড়িয়ে তোলে এবং শরীরে দ্রুত শক্তি প্রদান করে। ঘি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক।

কখন এবং কেন অশ্বগন্ধা খাওয়া উচিত না

১. গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যদানকালে:

গর্ভাবস্থা এবং স্তন্যদানকালে অশ্বগন্ধা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটি শরীরের হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে এবং শিশু বা মায়ের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।

২. অ্যুটোইমিউন রোগ থাকলে:

যাদের অ্যুটোইমিউন রোগ রয়েছে, যেমন লুপাস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, তাদের অশ্বগন্ধা গ্রহণ করা উচিত নয়, কারণ এটি ইমিউন সিস্টেমকে অতিরিক্ত সক্রিয় করতে পারে এবং রোগের অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে।

৩. যদি থাইরয়েড সমস্যা থাকে:

অশ্বগন্ধা থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা বাড়াতে পারে, যা হাইপারথাইরয়েডিজম বা অন্যান্য থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 24, 2024