সরিষা শাক হল সরিষা গাছের পাতা। এটি আমাদের দেশে খুবই পরিচিত একটি শাক, যা শীতকালে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সরিষা শাক দেখতে সবুজ এবং এর স্বাদ একটু তিতা। এটি রান্না করে খাওয়া হয়, আবার অনেক সময় কাঁচা সালাদ হিসেবেও খাওয়া হয়।

সরিষা শাকের প্রকারভেদ

সরিষা শাকের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত দুইটি প্রকারভেদ বেশি প্রচলিত:

১. সবুজ সরিষা শাক: এটি দেখতে একদম গাঢ় সবুজ এবং পাতাগুলো কিছুটা কুচকানো হয়। এই শাকের স্বাদ মৃদু তিতা এবং এটি রান্নায় বেশি ব্যবহৃত হয়।

২. লাল সরিষা শাক: এই শাকের পাতা কিছুটা লালচে সবুজ রঙের হয়। এটি দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনই পুষ্টিকর। এর স্বাদ সবুজ সরিষা শাকের চেয়ে একটু কম তিতা।

নিয়মিত সরিষা শাক খাওয়ার উপকারিতা

সরিষা শাক নিয়মিত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি নানান পুষ্টিগুণে ভরপুর, যা শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে।

  • উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন কেঃ সরিষা শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে থাকে, যা রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
  • আয়রনের ভালো উৎসঃ সরিষা শাক আয়রনের ভালো উৎস। এটি রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং শরীরের বিভিন্ন কোষে অক্সিজেন পৌঁছাতে সহায়ক।
  • অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট গুণাবলিঃ সরিষা শাকের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যেমন ভিটামিন সি, ই, এবং বিটা-ক্যারোটিন, যা দেহের কোষগুলোকে ফ্রি র‌্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
  • দৃষ্টিশক্তি বাড়াতেঃ সরিষা শাকে থাকা ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সহায়ক। এটি চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং রাত্রিকালীন অন্ধত্ব প্রতিরোধে কার্যকর।
  • হজমে সহায়কঃ সরিষা শাকে রয়েছে আঁশ, যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
  • হৃদযন্ত্রের জন্য ভালোঃ সরিষা শাকে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
  • ওজন নিয়ন্ত্রণেঃ যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য সরিষা শাক একটি ভালো খাবার। এটি কম ক্যালোরিযুক্ত হলেও পুষ্টিগুণে ভরপুর, যা দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।

সরিষা শাকের পুষ্টিগুণ

সরিষা শাক পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি শাক। প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষা শাকে সাধারণত যা থাকে:

  • ক্যালোরি: ২৭ ক্যালোরি
  • প্রোটিন: ২.৮ গ্রাম
  • ফ্যাট: ০.৪ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট: ৪.৭ গ্রাম
  • আঁশ: ৩.২ গ্রাম
  • ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ভিটামিন সি এবং ই
  • আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম

বয়সভেদে সরিষা শাক খাওয়া পরিমাণ

যে কোনো খাবারের মতোই, সরিষা শাক খাওয়ার পরিমাণও বয়স অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। আসুন জেনে নিই, কোন বয়সের মানুষের জন্য কতটুকু সরিষা শাক খাওয়া উচিত।

১. শিশুরা (১-৩ বছর)

শিশুদের ক্ষেত্রে সরিষা শাক খাওয়ানোর সময় বিশেষ যত্ন নিতে হয়। ১-৩ বছরের শিশুদের সরিষা শাক খাওয়ানোর পরিমাণ কম হওয়া উচিত, কারণ তাদের হজম প্রক্রিয়া এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। এক্ষেত্রে, সপ্তাহে ১-২ বার, আধা কাপ পরিমাণে সরিষা শাকের মিশ্রণ (যেমন, অন্যান্য সবজি বা ডাল দিয়ে রান্না করা) খাওয়ানো যেতে পারে।

২. বাচ্চারা (৪-১২ বছর)

এই বয়সের বাচ্চাদের সরিষা শাকের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান দরকার হয়, বিশেষ করে ভিটামিন কে, আয়রন এবং আঁশ। বাচ্চাদের সপ্তাহে ২-৩ বার এক কাপ পরিমাণে সরিষা শাক খাওয়ানো যেতে পারে। তবে প্রথমে রান্না করে নরম করে দিতে হবে যাতে তারা সহজেই খেতে পারে।

৩. কিশোর-কিশোরীরা (১৩-১৯ বছর)

এই বয়সের কিশোর-কিশোরীরা দ্রুত বৃদ্ধি এবং শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। সরিষা শাক এই বয়সের জন্য অত্যন্ত উপকারী কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে যা শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে। কিশোর-কিশোরীদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এক কাপ পরিমাণ সরিষা শাক রাখা উচিত।

৪. প্রাপ্তবয়স্করা (২০-৫৯ বছর)

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সরিষা শাক একটি অসাধারণ খাবার, কারণ এটি শরীরের প্রতিদিনের পুষ্টির চাহিদা পূরণে সহায়ক। প্রতি সপ্তাহে ৩-৪ দিন, এক কাপ করে সরিষা শাক খাওয়া উচিত। যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন তাদের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সরিষা শাক রাখা যেতে পারে।

৫. বয়স্করা (৬০ বছর এবং তার বেশি)

বয়স্কদের ক্ষেত্রে সরিষা শাক খাওয়ার পরিমাণ কিছুটা কমানো উচিত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হজম ক্ষমতা কিছুটা কমে যায়, তাই সরিষা শাকের পরিমাণ কমিয়ে, সপ্তাহে ২-৩ দিন, আধা কাপ করে খাওয়া উচিত। এটি তাদের জন্য পুষ্টি এবং ভিটামিন কে এর ভালো উৎস হতে পারে, যা হাড়ের স্বাস্থ্য এবং রক্তের জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া রক্ষায় সহায়ক।

কখন ও কিভাবে সরিষা শাক খাওয়া উচিত

১. সকাল বা দুপুরে:

সরিষা শাক সাধারণত সকালে বা দুপুরে খাওয়া উচিত। কারণ, এই সময় শরীরের হজম ক্ষমতা ভালো থাকে, যা শাকের পুষ্টি উপাদানগুলোকে সহজে শোষণ করতে সহায়ক। এছাড়া সরিষা শাক এঁটো খেলে তা রাতের খাবারের তুলনায় বেশি উপকারী হয়।

২. রান্না করে খাওয়া উচিত:

কাঁচা সরিষা শাক খাওয়া অনেকের জন্য একটু কঠিন হতে পারে, কারণ এর স্বাদ একটু তিতা। তাই সরিষা শাক সাধারণত রান্না করে খাওয়া উচিত। রান্নার সময় শাককে বেশি সিদ্ধ না করে অল্প ফোটানো ভালো, যাতে এর পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।

কোন কোন উপাদানের সাথে সরিষা শাক খাওয়া উচিত

১. রসুন ও সরিষার তেল:

রসুন এবং সরিষার তেলের সাথে সরিষা শাক রান্না করা খুবই জনপ্রিয় এবং স্বাস্থ্যকর একটি পদ্ধতি। রসুনের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ সরিষা শাকের সাথে মিলে শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে।

২. ডাল ও শাকের মিশ্রণ:

সরিষা শাকের সাথে মসুর ডাল বা অন্য কোনো ডাল মিশিয়ে খেলে এর পুষ্টিগুণ আরও বাড়ে। ডালের প্রোটিন এবং শাকের ভিটামিন ও মিনারেল মিলিয়ে এটি সম্পূর্ণ একটি খাবারে পরিণত হয়।

৩. আলু ও বেগুন:

সরিষা শাকের সাথে আলু এবং বেগুনের মিশ্রণও বেশ জনপ্রিয়। আলু শাকের তিতাভাব কমায় এবং বেগুনের সাথে মিলে এটি একটি মজাদার এবং পুষ্টিকর খাবার হয়।

কখন সরিষা শাক খাওয়া উচিত নয়

১. রাতে খাওয়া উচিত নয়:

সরিষা শাক রাতে খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, সরিষা শাক একটু ভারী এবং এটি হজম হতে সময় লাগে। রাতের খাবার হিসেবে এটি খেলে হজমে সমস্যা হতে পারে এবং পেটের অস্বস্তি হতে পারে।

২. গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে সতর্কতা:

গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েদের সরিষা শাক খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সরিষা শাকে কিছু উপাদান থাকতে পারে যা গর্ভাবস্থায় বা স্তন্যদানকালে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

৩. অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া উচিত নয়:

সরিষা শাক পুষ্টিকর হলেও অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়। এতে থাকা অক্সালেট কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া যারা থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন, তাদেরও সরিষা শাক খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 24, 2024