শজনে শাক, যাকে মোরিঙ্গা শাকও বলা হয়, একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবজি যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। শজনে গাছের পাতা থেকে এই শাক তৈরি হয়, এবং এটি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত কারণ এর পুষ্টিগুণ খুবই উচ্চমানের। শজনে শাকের পাতাগুলো ছোট ছোট, সবুজ রঙের এবং একটি আলাদা স্বাদযুক্ত যা সহজেই বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা যায়।
নিয়মিত শজনে শাক খাওয়ার উপকারিতা
১. উচ্চ পুষ্টিগুণ: শজনে শাক ভিটামিন এ, সি, এবং ই এর অন্যতম উৎস। এতে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও রয়েছে যা আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়।
২. হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি: শজনে শাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস থাকে যা হাড়ের জন্য উপকারী। এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে এবং অস্টিওপোরোসিসের মতো সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
৩. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: শজনে শাকে পটাসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: শজনে শাকের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
৫. ত্বকের যত্নে: শজনে শাকের ভিটামিন এ এবং ই ত্বকের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের বলিরেখা ও বার্ধক্যের লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে।
৬. হজমের সমস্যা সমাধান: শজনে শাকের ফাইবার হজমের সমস্যায় উপকারী। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে এবং হজম প্রক্রিয়া সহজ করে।
শজনে শাকের পুষ্টিগুণ
শজনে শাকের পুষ্টিগুণ উচ্চমানের। প্রতি ১০০ গ্রাম শজনে শাকে প্রায়:
- ক্যালরি: ৬৪
- প্রোটিন: ৯.৪ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ৮.৩ গ্রাম
- ফাইবার: ২.০ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ১৮৫ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ৪ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন সি: ৫২ মিলিগ্রাম
- ভিটামিন এ: ৬৮ মাইক্রোগ্রাম
বয়সভেদে শজনে শাক খাওয়ার পরিমাণ
বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য শজনে শাকের পরিমাণের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। আসুন জেনে নেই, কোন বয়সের মানুষের কতটুকু শজনে শাক খাওয়া উচিত:
১. শিশুরা (৬ মাস থেকে ৫ বছর):
শিশুদের জন্য শজনে শাক একটি ভালো খাবার হতে পারে, তবে খুব অল্প পরিমাণে খাওয়ানো উচিত। সপ্তাহে ২-৩ দিন, আধা চা চামচ পরিমাণ শজনে শাকের রস বা পাতলা স্যুপ আকারে খাওয়ানো যেতে পারে। এটি তাদের শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেল সরবরাহ করবে।
২. স্কুলগামী বাচ্চারা (৬ থেকে ১২ বছর):
এই বয়সে শিশুরা একটু বেশি পরিমাণে শজনে শাক খেতে পারে। সপ্তাহে ২-৩ বার, ১-২ টেবিল চামচ পরিমাণ শজনে শাকের রান্না করা তরকারি খাওয়ানো উচিত। এটি তাদের হাড়ের গঠনে সাহায্য করবে এবং শারীরিক বিকাশে সহায়ক হবে।
৩. কিশোর-কিশোরীরা (১৩ থেকে ১৮ বছর):
কিশোর-কিশোরীরা নিয়মিত শজনে শাক খেতে পারে। সপ্তাহে ৩-৪ বার, ২-৩ টেবিল চামচ পরিমাণ শজনে শাক খাওয়া উচিত। এই সময়ে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য শজনে শাকের পুষ্টিগুণ গুরুত্বপূর্ণ।
৪. প্রাপ্তবয়স্করা (১৯ থেকে ৫৯ বছর):
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য শজনে শাক একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। সপ্তাহে ৩-৫ দিন, ৩-৪ টেবিল চামচ পরিমাণ শজনে শাক খাওয়া উচিত। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, এবং হাড়ের স্বাস্থ্যে সহায়ক।
৫. বয়স্করা (৬০ বছর ও তার বেশি):
বয়স্কদের জন্য শজনে শাক বিশেষভাবে উপকারী। সপ্তাহে ৩-৪ বার, ২-৩ টেবিল চামচ পরিমাণ শজনে শাক খাওয়া উচিত। এটি হাড়ের স্বাস্থ্যে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে এবং তাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে।
কখন শজনে শাক খাওয়া উচিত
১. প্রাতঃরাশের সময়: সকালে প্রাতঃরাশের সময় শজনে শাক খাওয়া খুবই উপকারী। এটি আপনার শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে এবং দিনভর শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
২. দুপুরের খাবারের সময়: দুপুরের খাবারের সাথে শজনে শাক খাওয়া যায়। এটি আপনার হজম শক্তি বাড়ায় এবং শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগায়।
৩. সাপ্তাহিক অন্তর্ভুক্তি: শজনে শাক সপ্তাহে ৩-৪ বার খাওয়া উচিত। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
কিভাবে শজনে শাক খাওয়া উচিত
১. শজনে শাকের ভাজি: সরিষার তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আর একটু হলুদ দিয়ে শজনে শাকের ভাজি করা যায়। এটি খেতে সুস্বাদু হয় এবং স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।
২. ডাল এবং শজনে শাক: মুগ বা মসুর ডালের সাথে শজনে শাক রান্না করে খাওয়া যায়। ডালের সাথে শজনে শাকের সংমিশ্রণ শরীরে প্রোটিন ও ফাইবারের চাহিদা পূরণ করে।
৩. শাকের স্যুপ: শজনে শাক দিয়ে স্যুপ তৈরি করা যায়। এটি হজমে সহায়ক এবং শরীরকে হাইড্রেট রাখে।
৪. সবজি রান্না: শজনে শাক অন্যান্য সবজির সাথে রান্না করা যায়। এতে খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়ে এবং খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়।
কখন এবং কেন শজনে শাক খাওয়া উচিত না
১. রাতে: শজনে শাকের হালকা রেচক (laxative) গুণাবলী রয়েছে, যা রাতে খাওয়া হলে পেটের সমস্যা হতে পারে। তাই রাতে শজনে শাক খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।
২. অতিরিক্ত খেলে: শজনে শাকের অতিরিক্ত সেবন করা উচিত না, কারণ এতে কিডনিতে পাথর জমার সম্ভাবনা থাকে। এতে থাকা অক্সালেট অতিরিক্ত গ্রহণ করলে এই সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
৩. গর্ভাবস্থায়: গর্ভবতী নারীদের শজনে শাক খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কিছু ক্ষেত্রে এটি হরমোনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।