শরিফা ও আতা আমাদের দেশের একটি পরিচিত ফল। এ দুটি ফল একই জাতের হলেও স্বাদ এবং পুষ্টিগুণে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চলুন, আজকে আমরা জানবো শরিফা ও আতা কি, এর প্রকারভেদ কি, এবং নিয়মিত এই ফলগুলো খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে।
শরিফা ও আতা কি?
শরিফা (Annona squamosa) এবং আতা (Annona reticulata) একই প্রজাতির ফল। শরিফা সাধারণত বেশি জনপ্রিয় এবং মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে। আতা কিছুটা কম মিষ্টি এবং আকারে বড় হয়। উভয় ফলই হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী এবং এতে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে।
প্রকারভেদ
শরিফা এবং আতা মূলত দুই ধরনের হলেও, এগুলোর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে:
- শরিফা: ছোট, সবুজ রঙের, এবং খোসা পাতলা। এর ভিতরের অংশ সাদা এবং মিষ্টি।
- আতা: বড়, সবুজ বা হলুদাভ রঙের, এবং খোসা অপেক্ষাকৃত মোটা। এর ভিতরের অংশ সাদা বা হালকা পিঙ্ক এবং স্বাদে কিছুটা কম মিষ্টি।
শরিফা ও আতার ফল এর পুষ্টিগুণ
শরিফা এবং আতা দুটিই পুষ্টিগুণে ভরপুর। এর মধ্যে রয়েছে:
- ভিটামিন সি: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ফাইবার: হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
- পটাশিয়াম: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ম্যাগনেসিয়াম: হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
নিয়মিত শরিফা ও আতা ফল খাওয়ার উপকারিতা
নিয়মিত শরিফা ও আতা খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো:
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: শরিফা এবং আতার ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- হজম শক্তি বৃদ্ধি: এ ফলের ফাইবার হজম প্রক্রিয়া সুগম করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে।
- হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা: পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- শক্তি প্রদান: শরিফা এবং আতার প্রাকৃতিক শর্করা শরীরকে তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করে।
- ত্বকের যত্ন: এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের সজীবতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করে।
- ক্যান্সার প্রতিরোধ: শরিফা এবং আতার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
বয়সভেদে শরিফা ও আতার ফল এর পরিমাণ
শরিফা ও আতা আমাদের দেশের খুবই পরিচিত ও সুস্বাদু ফল। এর পুষ্টিগুণ অনেক এবং স্বাস্থ্য উপকারিতাও প্রচুর। কিন্তু বয়সভেদে শরিফা ও আতার পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। চলুন, বয়স অনুযায়ী শরিফা ও আতার পরিমাণ নিয়ে বিস্তারিত জানি।
শিশুরা (১-৫ বছর)
শিশুদের শরিফা ও আতা খাওয়ানোর ক্ষেত্রে একটু সতর্ক হতে হয় কারণ এদের হজম শক্তি সম্পূর্ণরূপে উন্নত হয় না।
- পরিমাণ: দিনে ১/৪ থেকে ১/২ কাপ।
- কারণ: শিশুরা বেশি খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে, তাই সীমিত পরিমাণে খাওয়ানো উচিত।
- উপকারিতা: ভিটামিন সি এবং ফাইবার শিশুদের ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে।
বাচ্চারা (৬-১২ বছর)
এই বয়সের বাচ্চাদের শরিফা ও আতা খাওয়ানো নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর।
- পরিমাণ: দিনে ১/২ থেকে ১ কাপ।
- কারণ: এই বয়সে বাচ্চাদের হজম শক্তি ভালো হয় এবং তাদের শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।
- উপকারিতা: শক্তি প্রদান, হজম শক্তি বৃদ্ধি, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।
কিশোর-কিশোরী (১৩-১৮ বছর)
কিশোর-কিশোরীদের শরীরের দ্রুত বৃদ্ধি এবং শারীরিক কার্যক্রম বেশি থাকে।
- পরিমাণ: দিনে ১ কাপ।
- কারণ: এই বয়সে পুষ্টির চাহিদা বেশি থাকে, তাই শরিফা ও আতা খাওয়া খুবই উপকারী।
- উপকারিতা: শক্তি প্রদান, পুষ্টি ঘাটতি পূরণ, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি।
যুবক-যুবতী (১৯-৩০ বছর)
এই বয়সের মানুষেরা কর্মক্ষম থাকে এবং বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যায়।
- পরিমাণ: দিনে ১-১.৫ কাপ।
- কারণ: এই বয়সে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ।
- উপকারিতা: শক্তি প্রদান, হজম শক্তি উন্নতি, এবং হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা।
মধ্যবয়সী (৩১-৫০ বছর)
মধ্যবয়সী মানুষের শরীরের পুষ্টি চাহিদা কমে আসে কিন্তু হজম শক্তি বজায় রাখা জরুরি।
- পরিমাণ: দিনে ১ কাপ।
- কারণ: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হজম শক্তি কমে যেতে পারে, তাই পুষ্টি বজায় রাখা প্রয়োজন।
- উপকারিতা: হজম শক্তি বজায় রাখা, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সরবরাহ, এবং হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা।
প্রবীণরা (৫০+ বছর)
প্রবীণদের শরীরের পুষ্টি চাহিদা এবং হজম শক্তি কমে যায়, তাই তাদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- পরিমাণ: দিনে ১/২ থেকে ১ কাপ।
- কারণ: প্রবীণদের হজম ক্ষমতা কমে যায় এবং তারা অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।
- উপকারিতা: হজম শক্তি উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা।
কখন শরিফা ও আতা ফল খাওয়া উচিত
- সকালে: সকালের নাশতায় শরিফা ও আতা খাওয়া খুবই উপকারী। এতে পাওয়া যায় প্রাকৃতিক শর্করা, যা আমাদের দিন শুরু করতে সাহায্য করে এবং তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদান করে।
- বিকালে: বিকালের নাস্তায় এই ফলগুলো খাওয়া যেতে পারে। কাজের ব্যস্ততার পরে বিকালে শরিফা ও আতা খেলে তা আমাদের মানসিক ও শারীরিক অবসাদ দূর করে।
- খাওয়ার পর: দুপুর বা রাতের খাবারের পরে মিষ্টি হিসেবে শরিফা ও আতা খাওয়া যেতে পারে। এতে খাবার পরিপাক হয় এবং মিষ্টির তৃষ্ণা মেটায়।
কিভাবে শরিফা ও আতা ফল খাওয়া উচিত
- তাজা ফল হিসেবে: শরিফা ও আতা তাজা খাওয়া সবচেয়ে ভালো। এতে এর সমস্ত পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।
- ফলের সালাদে: শরিফা ও আতা অন্যান্য ফলের সাথে মিশিয়ে সালাদ তৈরি করা যায়। এটি হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং রুচির উন্নতি ঘটায়।
- স্মুদি: শরিফা ও আতা দিয়ে স্মুদি তৈরি করা যেতে পারে। এটি খুবই পুষ্টিকর এবং তৃপ্তিদায়ক।
কোন কোন উপাদানের সাথে শরিফা ও আতা ফল খাওয়া ভালো
- দুধ: শরিফা ও আতা দুধের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের সমৃদ্ধ উৎস।
- মধু: মধুর সাথে শরিফা ও আতা খেলে স্বাদ আরও বাড়ে এবং এটি হজমে সহায়ক।
- নাটস: বাদাম, কাজু, পেস্তা ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে খেলে শরিফা ও আতা আরও পুষ্টিকর হয়।
কখন এবং কেন শরিফা ও আতা খাওয়া উচিত না
- রাতের বেলায় বেশি খাওয়া: রাতের বেলায় বেশি পরিমাণে শরিফা ও আতা খাওয়া উচিত নয়। এতে হজম সমস্যা হতে পারে এবং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
- ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য: শরিফা ও আতা উচ্চ শর্করাযুক্ত ফল, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের এটি পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। বেশি খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
- পেটের সমস্যার সময়: যদি আপনার পেটের সমস্যা থাকে, যেমন গ্যাস, অ্যাসিডিটি বা ডায়রিয়া, তবে শরিফা ও আতা খাওয়া এড়িয়ে চলুন। এতে সমস্যা আরও বেড়ে যেতে পারে।
- অ্যালার্জি: যাদের শরিফা বা আতার প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের এই ফলগুলো খাওয়া একদমই উচিত নয়। এতে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হতে পারে।