বিটরুট হলো একটি মিষ্টি স্বাদের সবজি যা মূলত মাটির নিচে জন্মায়। এটি সাধারণত লাল বা গাঢ় বেগুনি রঙের হয় এবং রান্নায় বা কাঁচা খাওয়া যায়। বিটরুট স্যালাড, স্যুপ, জুস বা রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

বিটরুটের প্রকারভেদ

বিটরুটের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যা তাদের রঙ, আকার এবং স্বাদের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন হতে পারে। প্রধান প্রকারভেদগুলো হলো:

১. লাল বিটরুট: এটি সবচেয়ে প্রচলিত বিটরুট। লাল বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

২. গোল্ডেন বিটরুট: এই বিটরুটের রঙ হলুদ বা সোনালী হয়। এটি স্বাদে কিছুটা মিষ্টি এবং কম মাটি স্বাদযুক্ত।

৩. চিওগ্গিয়া বিটরুট: এই বিটরুটের ভিতরে লাল ও সাদা রঙের বৃত্ত থাকে। এটি দেখতে খুব সুন্দর এবং স্বাদে মিষ্টি।

নিয়মিত বিটরুট খাওয়ার উপকারিতা

১. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক

বিটরুটে থাকা নাইট্রেট রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এটি রক্তনালীকে শিথিল করতে এবং রক্ত প্রবাহ উন্নত করতে সাহায্য করে, যা উচ্চ রক্তচাপ কমায়।

২. রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ

বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে আয়রন এবং ফলিক এসিড থাকে, যা রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক। এটি রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে এবং রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।

৩. লিভার ডিটক্সিফিকেশন

বিটরুট লিভারকে ডিটক্সিফাই করতে সহায়ক। এতে থাকা বিটালাইন লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নত করে এবং টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।

৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

বিটরুটে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এটি সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

৫. হজমশক্তি উন্নত

বিটরুটে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে, যা হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক। এটি অন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং হজমশক্তি উন্নত করে।

৬. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়

বিটরুটে থাকা পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং কোলেস্টেরল কমায়।

৭. মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী

বিটরুট মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এতে থাকা বিটালাইন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান মানসিক চাপ কমাতে এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

বিটরুটের পুষ্টিগুণ

  • ক্যালরি: ১০০ গ্রাম বিটরুটে প্রায় ৪৩ ক্যালরি থাকে।
  • কার্বোহাইড্রেট: ৯.৫৬ গ্রাম
  • প্রোটিন: ১.৬১ গ্রাম
  • ফাইবার: ২.৮ গ্রাম
  • ভিটামিন সি: ৪.৯ মিলিগ্রাম (প্রায় ৮% ডেইলি ভ্যালু)
  • ফলিক এসিড: ১০৯ মাইক্রোগ্রাম (প্রায় ২৭% ডেইলি ভ্যালু)
  • পটাসিয়াম: ৩২৫ মিলিগ্রাম (প্রায় ৯% ডেইলি ভ্যালু)
  • ম্যাগনেসিয়াম: ২৩ মিলিগ্রাম
  • আয়রন: ০.৮ মিলিগ্রাম

বয়সভেদে বিটরুট খাওয়ার পরিমাণ

বিটরুট একটি পুষ্টিকর সবজি যা সব বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। তবে, বয়স অনুযায়ী বিটরুট খাওয়ার পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। আসুন, বয়সভেদে বিটরুট খাওয়ার সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

শিশু (১-১২ বছর)

শিশুদের জন্য বিটরুট খাওয়া একটি ভাল পুষ্টির উৎস হতে পারে। দিনে একবার নাস্তার সময় বা দুপুরের খাবারে প্রায় ৩০-৫০ গ্রাম বিটরুট খাওয়ানো যেতে পারে। এটি তাদের পেটের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

কিশোর-কিশোরী (১৩-১৮ বছর)

এই বয়সে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দ্রুত ঘটে, ফলে বেশি পুষ্টির প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন ৫০-৭০ গ্রাম বিটরুট নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া তাদের জন্য উপকারী। এটি তাদের মেটাবলিজম উন্নত করবে এবং শক্তি যোগাবে।

যুবক-যুবতী (১৯-৩০ বছর)

এই বয়সে শরীরের চাহিদা বেশি থাকে এবং ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অনেক শক্তি প্রয়োজন। প্রতিদিন ৭০-১০০ গ্রাম বিটরুট নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি তাদের শরীরে প্রাকৃতিক শক্তি যোগাবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।

মধ্যবয়সী (৩১-৫০ বছর)

এই বয়সে শরীরের বিপাকীয় হার কিছুটা কমে যায় এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বেশি থাকে। প্রতিদিন ৭০-১০০ গ্রাম বিটরুট নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত। এটি তাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।

প্রবীণ (৫০ বছরের উপরে)

প্রবীণদের হজম প্রক্রিয়া ও শারীরিক কার্যক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। তাদের জন্য প্রতিদিন ৫০-৭০ গ্রাম বিটরুট নাস্তা হিসেবে বা স্যুপ, স্মুদি বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে যথেষ্ট। এটি তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।

কখন বিটরুট খাওয়া উচিত

সকালে নাস্তার সময়

সকালে নাস্তার সময় বিটরুট খাওয়া শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং সারাদিনের জন্য শরীরে প্রাকৃতিক শক্তি যোগায়। সকালে বিটরুট খেলে হজমশক্তি ভালো থাকে এবং পেট পরিষ্কার থাকে।

দুপুরের খাবারের সাথে

দুপুরের খাবারের সাথে বিটরুট খাওয়া একটি চমৎকার উপায়। এটি খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। দুপুরের খাবারের সাথে বিটরুট খেলে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং খাবারের পুষ্টিগুণ শোষণে সহায়ক হয়।

ব্যায়ামের পরে

ব্যায়ামের পরে বিটরুট খাওয়া শরীরের জন্য পুনরুজ্জীবিত হিসেবে কাজ করে। এতে থাকা প্রাকৃতিক নাইট্রেট রক্ত প্রবাহ উন্নত করে এবং পেশি পুনর্গঠনে সহায়ক।

কিভাবে বিটরুট খাওয়া উচিত

কাঁচা খাওয়া

বিটরুট কাঁচা খাওয়া যেতে পারে। এটি সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি। কাঁচা বিটরুট কেটে সালাদ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে।

জুস বানিয়ে

বিটরুট জুস বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এক গ্লাস বিটরুট জুস সকালে বা সন্ধ্যায় পান করা স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর।

রান্না করে

বিটরুট রান্না করে খাওয়া যেতে পারে। এটি স্যুপ, স্ট্যু বা অন্যান্য রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বিটরুট রান্না করে খেলে এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ে।

কোন কোন উপাদানের সাথে বিটরুট খাওয়া উচিত

গাজর

বিটরুটের সাথে গাজর মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি সালাদ বা জুস হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। গাজর ও বিটরুট মিশিয়ে খেলে পুষ্টিগুণ বাড়ে এবং স্বাদে বৈচিত্র্য আনে।

আপেল

বিটরুটের সাথে আপেল মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি জুস বা স্মুদি হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। আপেল ও বিটরুট মিশিয়ে খেলে স্বাদ বৃদ্ধি পায় এবং পুষ্টিগুণ যোগ হয়।

লেবুর রস

বিটরুটের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি সালাদ বা জুসের স্বাদ বাড়ায় এবং ভিটামিন সি যোগ করে।

কখন এবং কেন বিটরুট খাওয়া উচিত না

কিডনি পাথরের সমস্যা থাকলে

যাদের কিডনি পাথরের সমস্যা আছে তাদের জন্য বিটরুট খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। বিটরুটে অক্সালেট থাকে যা কিডনি পাথরের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

নিম্ন রক্তচাপ থাকলে

যাদের নিম্ন রক্তচাপ আছে তাদের জন্য অতিরিক্ত বিটরুট খাওয়া উচিত নয়। বিটরুট রক্তচাপ কমাতে সহায়ক, যা নিম্ন রক্তচাপের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

ডায়রিয়ার সমস্যা থাকলে

যাদের ডায়রিয়ার সমস্যা আছে তাদের জন্য বিটরুট খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। বিটরুট ফাইবারে সমৃদ্ধ, যা ডায়রিয়ার সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 24, 2024