মুখ ও গলার ক্যান্সার হলো এক ধরনের ক্যান্সার যা মুখগহ্বর, জিহ্বা, ঠোঁট, গলা, এবং টনসিলের কোষে সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণত মিউকাস মেমব্রেনের কোষ থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে আশেপাশের কোষগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এই ক্যান্সারকে অরোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সারও বলা হয়। মুখ ও গলার ক্যান্সার প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

কী কারণে মুখ ও গলার ক্যান্সার হতে পারে?

মুখ ও গলার ক্যান্সার বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কিছু প্রধান কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান নিচে আলোচনা করা হলো:

১. তামাক ব্যবহার

সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, পাইপ, এবং চিউইং টোব্যাকো (জর্দা, গুল) ব্যবহারের কারণে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তামাকের মধ্যে থাকা বিভিন্ন কেমিক্যাল মুখের কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা ক্যান্সারের সৃষ্টি করে।

২. অ্যালকোহল

অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনও মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তামাক এবং অ্যালকোহল একসাথে ব্যবহারের ফলে ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।

৩. HPV (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)

HPV সংক্রমণ বিশেষ করে টাইপ ১৬ মুখ ও গলার ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এটি সাধারণত যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়।

৪. অসুস্থ খাদ্যাভ্যাস

ফলমূল ও শাকসবজি কম খাওয়া, অতিরিক্ত প্রসেসড খাবার ও লাল মাংস খাওয়ার ফলে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। পুষ্টিহীন খাদ্য মুখের কোষের সুস্থতা নষ্ট করতে পারে।

৫. সূর্যের রশ্মি

বাইরের কাজে নিয়মিত সূর্যের তীব্র রশ্মিতে মুখের ঠোঁটের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ঠোঁটের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৬. জিনগত কারণ

পরিবারের কারো মুখ ও গলার ক্যান্সার থাকলে অন্যান্য সদস্যদেরও ঝুঁকি বাড়ে।

মুখ ও গলার ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কি?

মুখ ও গলার ক্যান্সারের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে। এই লক্ষণগুলো শুরুতে হালকা হতে পারে, তবে সময়ের সাথে সাথে তা গুরুতর হতে পারে। মুখ ও গলার ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণগুলো নিচে দেওয়া হলো:

১. মুখে বা গলায় ঘা বা ফোলা

মুখের ভেতরে বা গলার কোনো স্থানে ঘা বা ফোলা দেখা দিলে তা ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এই ধরনের ঘা দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে এবং সহজে ভালো না হলে তা নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

২. গলার মধ্যে ব্যথা

গলার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করলে তা মুখ ও গলার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে, যদি ব্যথা গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা সৃষ্টি করে।

৩. মুখের ভিতরে সাদা বা লাল দাগ

মুখের ভিতরে সাদা বা লাল রঙের দাগ বা প্যাচ দেখা দিলে তা ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এটি লিউকোপ্লাকিয়া বা এরিথ্রোপ্লাকিয়ার লক্ষণ হতে পারে, যা ক্যান্সারের পূর্বাভাস হতে পারে।

৪. দাঁতের সমস্যা

যদি হঠাৎ করে দাঁত নড়ে যায় বা দাঁতের আশেপাশে ব্যথা হয়, তাহলে তা মুখের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

৫. কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন

কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন, যেমন কণ্ঠস্বর বসে যাওয়া বা গলা ভাঙা, মুখ ও গলার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

৬. কান ব্যথা

কানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা অস্বস্তি মুখ ও গলার ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।

৭. ওজন কমে যাওয়া

অকারণে ওজন কমে যাওয়া অনেক সময় ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ।

৮. নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ

মুখের ভিতরে ক্যান্সারের কারণে অনেক সময় নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে।

বয়সভেদে মুখ ও গলার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা

মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম হতে পারে। নিচে বয়সভেদে মুখ ও গলার ক্যান্সারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

কিশোর ও তরুণ

  • ১৫-৩০ বছর: এই বয়সে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে HPV সংক্রমণজনিত ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।

প্রাপ্তবয়স্ক

  • ৩১-৫০ বছর: এই বয়সে তামাক ও অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। কর্মজীবনে স্ট্রেস ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এই ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়।

মধ্যবয়স্ক

  • ৫১-৬৫ বছর: এই বয়সে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। দীর্ঘ সময় তামাক ও অ্যালকোহল ব্যবহারের ফলে এই বয়সে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই বয়সে ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

বৃদ্ধ

  • ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে: এই বয়সে মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে এই বয়সে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

মুখ ও গলার ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়গুলো কি কি?

মুখ ও গলার ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা আমাদের জীবনযাত্রার উপর নির্ভর করে অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর কিছু কার্যকর উপায় নিচে আলোচনা করা হলো:

১. তামাক ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা

তামাক এবং অ্যালকোহল মুখ ও গলার ক্যান্সারের প্রধান কারণ। ধূমপান, চিউইং টোব্যাকো এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের অভ্যাস ত্যাগ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো যায়।

২. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। কিছু পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস নিচে দেওয়া হলো:

  • সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল: পালং শাক, ব্রকলি, গাজর, টমেটো, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি ইত্যাদি সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া উচিত। এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করে।
  • পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটমিল, এবং গোটা গমের রুটি খাওয়া উচিৎ, যা ফাইবার সমৃদ্ধ এবং শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সহায়ক।
  • প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য: মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া উচিৎ, যা শরীরের কোষ গঠনে সহায়ক।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান

প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত। পানি শরীরের সমস্ত টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে এবং কোষের স্বাস্থ্য বজায় রাখে।

৪. সঠিক ওজন বজায় রাখা

সঠিক ওজন বজায় রাখা মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে সঠিক ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

5. নিয়মিত দাঁতের যত্ন

দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করা মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। প্রতিদিন দুইবার দাঁত ব্রাশ করা, ফ্লস ব্যবহার করা এবং নিয়মিত দাঁতের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

৬. সূর্যের রশ্মি থেকে সুরক্ষা

বাইরে গেলে ঠোঁট এবং মুখকে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করতে সানস্ক্রিন বা লিপ বাম ব্যবহার করা উচিত। সূর্যের অতিরিক্ত তাপ মুখের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৭. HPV ভ্যাকসিন

HPV ভাইরাস মুখ ও গলার ক্যান্সারের একটি বড় কারণ। HPV ভ্যাকসিন নেওয়া মুখ ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।

৮. মানসিক চাপ কমানো

অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া উচিত।

মুখ ও গলার ক্যান্সার প্রতিরোধে সঠিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। আপনার এবং আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এই উপায়গুলো অনুসরণ করুন এবং সুস্থ থাকুন। যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024