ব্লাড ক্যান্সার কি?
ব্লাড ক্যান্সার, যা লিউকেমিয়া নামেও পরিচিত, এটা হল এমন একটি ক্যান্সার যা রক্ত এবং রক্ত সৃষ্টিকারী অঙ্গগুলোতে আক্রমণ করে। আমাদের শরীরে রক্ত কোষ তৈরি হয় বোন ম্যারোতে এবং ব্লাড ক্যান্সার হলে এই প্রক্রিয়ায় সমস্যা হয়। স্বাভাবিক রক্ত কোষের পরিবর্তে, ক্যান্সার কোষ গুলো বেড়ে উঠে এবং স্বাভাবিক রক্ত কোষ গুলোর জায়গা দখল করে নেয়। এটি রক্তে অক্সিজেন পরিবহন, ইনফেকশন প্রতিরোধ এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে।
ব্লাড ক্যান্সারের প্রকারভেদ
ব্লাড ক্যান্সারের প্রধান তিনটি প্রকারভেদ আছে:
- লিউকেমিয়া: এটি সরাসরি রক্ত এবং বোন ম্যারোকে প্রভাবিত করে।
- লিম্ফোমা: এটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে আক্রমণ করে, যা শরীরের ইনফেকশন প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।
- মাইলোমা: এটি প্লাজমা কোষকে প্রভাবিত করে, যা রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
কী কারণে ব্লাড ক্যান্সার হতে পারে?
ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণগুলি এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি, তবে কিছু কারণ এবং ঝুঁকি ফ্যাক্টর রয়েছে যা এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। কিছু প্রধান কারণগুলো হলো:
- জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারের মধ্যে কারো ব্লাড ক্যান্সার থাকলে আপনারও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- রেডিয়েশন: অতিরিক্ত রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসা, যেমন কেমোথেরাপি বা অন্যান্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিয়েশন, ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- কেমিক্যাল: কিছু রাসায়নিক, যেমন বেনজিন এবং ফর্মালডিহাইডের সংস্পর্শে আসা, রক্ত কোষের ক্ষতি করে ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী ইনফেকশন: কিছু ভাইরাস, যেমন হিউম্যান টি-সেল লিম্ফোট্রপিক ভাইরাস (HTLV-1) এবং হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (HIV), ব্লাড ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়।
- দুর্বল ইমিউন সিস্টেম: জন্মগত বা কোনো চিকিৎসার কারণে দুর্বল ইমিউন সিস্টেম থাকলে ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কি কি?
ব্লাড ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো বিভিন্ন হতে পারে এবং অনেক সময় এগুলো অন্যান্য রোগের সাথে মিলে যায়। তবে, কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হল:
- অতিরিক্ত ক্লান্তি: শরীরে পর্যাপ্ত রক্ত কোষের অভাব হলে, আপনি সবসময় ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন।
- জ্বর ও ইনফেকশন: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে ঘন ঘন জ্বর বা ইনফেকশন হতে পারে।
- ওজন হ্রাস: কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যেতে পারে।
- রাতের ঘাম: রাত্রে অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে যা স্বাভাবিক নয়।
- হাড় ও গাঁটে ব্যথা: বোন ম্যারোতে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি হলে হাড় ও গাঁটে ব্যথা হতে পারে।
- ত্বকে সহজে ক্ষত হওয়া বা রক্তক্ষরণ: রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হলে ত্বকে সহজে ক্ষত হতে পারে বা রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- লিম্ফ নোড ফোলা: গলায়, বগলে বা কুঁচকিতে লিম্ফ নোড ফুলে যেতে পারে।
- শ্বাসকষ্ট: রক্তে অক্সিজেনের অভাব হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
বয়সভেদে ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা
ব্লাড ক্যান্সার যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে, তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। বয়সভেদে ব্লাড ক্যান্সারের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
শিশুরা (০-১৫ বছর):
লিউকেমিয়া: শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ব্লাড ক্যান্সার। এই বয়সে ব্লাড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে কারণ শিশুদের শরীরে দ্রুত কোষ বিভাজন ঘটে, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ায়।
তরুণ ও যুবক (১৬-৪০ বছর):
হজকিন লিম্ফোমা: এই বয়সের মানুষের মধ্যে হজকিন লিম্ফোমা বেশি দেখা যায়। এটি লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে শুরু হয় এবং তরুণদের মধ্যে বেশি ছড়ায়।
মধ্যবয়স্ক (৪১-৬০ বছর):
ক্রনিক মাইলোজেনাস লিউকেমিয়া (CML): মধ্যবয়স্কদের মধ্যে এই ধরণের ব্লাড ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। এই বয়সে শরীরের বিভিন্ন কোষে জেনেটিক পরিবর্তন বেশি হতে পারে, যা ব্লাড ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
বৃদ্ধ (৬১ বছর ও তদূর্ধ্ব):
নন-হজকিন লিম্ফোমা এবং মাইলোমা: বয়স্কদের মধ্যে এই ধরনের ব্লাড ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যায়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় গুলো কি কি?
ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য সরাসরি কোনো নিশ্চিত উপায় নেই, তবে কিছু জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এর ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে। ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু কার্যকর উপায় নিচে দেওয়া হলো:
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা:
একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আপনার খাদ্য তালিকায় নিচের উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:
- সবুজ শাক-সবজি: পালং শাক, কেল, ব্রকলি ইত্যাদি সবুজ শাক-সবজি অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- ফলমূল: তাজা ফল, বিশেষ করে বেরি, কমলালেবু, আপেল ইত্যাদি খেলে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ হয়।
- সম্পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটস, এবং সম্পূর্ণ গমের রুটি খান যা ফাইবার এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ।
২. প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন:
প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন হট ডগ, বেকন, সসেজ ইত্যাদি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এসব খাবারে প্রিজারভেটিভ এবং রাসায়নিক থাকে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক।
৩. ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন:
ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানে তামাকের উপস্থিতি রক্ত ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। মদ্যপান নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, যদি সম্ভব হয় পুরোপুরি ত্যাগ করাই শ্রেয়।
৪. নিয়মিত ব্যায়াম করুন:
নিয়মিত ব্যায়াম রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন, যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং, অথবা যোগব্যায়াম।
৫. পর্যাপ্ত ঘুম:
পর্যাপ্ত ঘুম ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ায়। প্রতিরাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমের অভাব ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, যা বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
৬. মানসিক চাপ কমান:
অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। চাপ কমাতে নিয়মিত ধ্যান, যোগব্যায়াম, এবং শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন।
৭. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে ব্লাড ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দ্রুত শনাক্ত করা যায়। যদি আপনি ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন, যেমন আপনার পরিবারের মধ্যে কারো ব্লাড ক্যান্সার থাকলে, নিয়মিত চেকআপ করানো গুরুত্বপূর্ণ।