থাইরয়েড ক্যান্সার কি?
থাইরয়েড ক্যান্সার হল একটি বিশেষ ধরনের ক্যান্সার যা থাইরয়েড গ্রন্থিতে ঘটে। থাইরয়েড গ্রন্থি গলার সামনে, ঠিক কলারবোন এর উপরে অবস্থিত একটি ছোট গ্রন্থি। এই গ্রন্থি আমাদের শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে এবং হরমোন উৎপন্ন করে।
থাইরয়েড ক্যান্সার সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সহজে ধরা পড়ে না। তবে, সঠিক সময়ে নির্ণয় এবং চিকিৎসা পেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য।
থাইরয়েড ক্যান্সারের প্রকারভেদ
থাইরয়েড ক্যান্সারকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সার: এটি সবচেয়ে দূবর্ল ধরনের থাইরয়েড ক্যান্সার এবং সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়।
- ফলিকুলার থাইরয়েড ক্যান্সার: এটি সাধারণত মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটে এবং এটি তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
- মেডুলারি থাইরয়েড ক্যান্সার: এই ধরনের ক্যান্সার থাইরয়েড গ্রন্থির C-cells থেকে উৎপন্ন হয় যা ক্যালসিটোনিন হরমোন উৎপন্ন করে।
- অ্যানাপ্লাস্টিক থাইরয়েড ক্যান্সার: এটি খুবই বিরল এবং সবচেয়ে আগ্রাসী ধরনের থাইরয়েড ক্যান্সার।
থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণ
থাইরয়েড ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হল:
- গলায় গুটি: গলার সামনে একটি কঠিন গুটি অনুভূত হওয়া যা বৃদ্ধি পায়।
- গলার ব্যথা: গলার সামনে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা।
- কণ্ঠস্বর পরিবর্তন: কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে যাওয়া বা ভাঙা ভাঙা হয়ে যাওয়া।
- গিলতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট: খাবার গিলতে বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- গলার লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া: গলার লিম্ফ নোডগুলো ফুলে যাওয়া।
থাইরয়েড ক্যান্সার নির্ণয়
থাইরয়েড ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়:
শারীরিক পরীক্ষা: গলার সামনে গুটি বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়।
আলট্রাসাউন্ড: থাইরয়েড গ্রন্থির অভ্যন্তরীণ চিত্র নেওয়া হয়।
বায়োপসি: গলার গুটি থেকে একটি ছোট নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা: থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
কী কারণে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে?
থাইরয়েড ক্যান্সারের কারণসমূহ
থাইরয়েড ক্যান্সার সাধারণত বিভিন্ন কারণের জন্য হতে পারে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ হলো:
পরিবেশগত কারণ: উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসা, যেমন পারমাণবিক বিপর্যয় থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারে থাইরয়েড ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশেষত, মেডুলারি থাইরয়েড ক্যান্সার বংশগত হতে পারে।
আয়োডিনের অভাব: শরীরে আয়োডিনের অভাব থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
লিঙ্গ ও বয়স: মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় বেশি থাকে, বিশেষ করে ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মধ্যে।
বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসা: কিছু বিষাক্ত পদার্থ যেমন থ্যালিয়াম, যা শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়, এটা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বয়সভেদে থাইরয়েড ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা
শিশু এবং কিশোর
শিশু এবং কিশোরদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঘটনা খুবই বিরল। তবে, যদি কোনো শিশু বা কিশোর উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসে, যেমন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি, তাহলে তাদের মধ্যে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
২০-৩০ বছর বয়স
এই বয়সের মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। এই সময়ে শরীরে হরমোনের পরিবর্তন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
৩০-৫০ বছর বয়স
৩০-৫০ বছর বয়সের মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি সর্বাধিক। এই সময়ে মহিলাদের হরমোনের পরিবর্তন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে থাইরয়েড ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি থাকে। পুরুষদের মধ্যে এই বয়সে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা কম হলেও, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৫০ বছর এবং তদুর্ধ্ব
৫০ বছর এবং তদুর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা কমে আসে। তবে, যদি কোনো ব্যক্তি দীর্ঘসময় ধরে থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকেন বা যদি তাদের পরিবারের ইতিহাসে থাইরয়েড ক্যান্সার থাকে, তাহলে এই বয়সে তাদের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
থাইরয়েড ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়গুলো কি কি?
১. সঠিক পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। থাইরয়েড ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু পুষ্টিকর খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ:
- আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার: আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়োডিন থাকা খুবই জরুরি। আয়োডিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন সামুদ্রিক মাছ, ডেইরি প্রোডাক্ট (দুধ, দই), ডিম, এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া উচিত।
- সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূল: প্রতিদিন সবুজ শাক-সবজি এবং বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম মজবুত হয়।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বেরি (স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি), টমেটো, এবং ব্রকলি ইত্যাদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত, যা শরীরের ফ্রি র্যাডিক্যাল কমিয়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
২. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা থাইরয়েড ক্যান্সার সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ে সাহায্য করে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলো:
- থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট: থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা।
- আলট্রাসাউন্ড: থাইরয়েড গ্রন্থির আকার ও আকৃতি পরীক্ষা করা।
- বায়োপসি: থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক গুটি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা।
৩. রেডিয়েশনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা
রেডিয়েশন থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই, রেডিয়েশনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত:
চিকিৎসার সময় সতর্কতা: কোনো চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রেডিয়েশন ব্যবহার হলে তা নিরাপদ উপায়ে করা উচিত।
পরিবেশগত সুরক্ষা: পারমাণবিক বিপর্যয় বা রেডিয়েশন সমৃদ্ধ স্থান থেকে দূরে থাকা উচিত।
৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব:
- ধূমপান বর্জন: ধূমপান থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই, ধূমপান বর্জন করা উচিত।
- নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয় এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাইরয়েডের সমস্যা বাড়াতে পারে। তাই, যোগব্যায়াম বা মেডিটেশনের মাধ্যমে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
৫. সঠিক ওষুধ ও চিকিৎসা
থাইরয়েডের কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং সঠিক ওষুধ ও চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
সঠিক সময়ে নির্ণয় এবং চিকিৎসা পেলে থাইরয়েড ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তাই গলার কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।