আমরা সবাই জানি যে ক্যান্সার একটি প্রাণঘাতী রোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম।

ফুসফুসের ক্যান্সার কি?

ফুসফুসের ক্যান্সার হল এক ধরনের ক্যান্সার যা ফুসফুসের কোষগুলোতে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় এবং টিউমার তৈরি করে। এই টিউমারগুলি ধীরে ধীরে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কেন ফুসফুসের ক্যান্সার হয়?

ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

  • ধূমপান: ফুসফুসের ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান কারণ ধূমপান। তামাকের ধোঁয়া ফুসফুসের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • প্যাসিভ স্মোকিং: যারা নিজেরা ধূমপান করেন না কিন্তু ধূমপায়ীদের আশেপাশে থাকেন, তারাও এই ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন। একে প্যাসিভ স্মোকিং বলা হয়।
  • এয়ার পলিউশন: বায়ু দূষণও ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি কারণ। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল ও বড় শহরে বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি থাকে।
  • রেডন গ্যাস: বাড়ির ভিতরে রেডন গ্যাস জমা হলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এটি মাটির নিচে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়।
  • আসবেস্টস: আসবেস্টস ফাইবারের সাথে নিয়মিত সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • পারিবারিক ইতিহাস: যদি পরিবারের কারও ফুসফুসের ক্যান্সার থাকে, তাহলে অন্যান্য সদস্যদের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ

ফুসফুসের ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ হয়। ফুসফুসের ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ দেওয়া হলো:

  • ধূমপানজনিত কাশি: দীর্ঘমেয়াদী ধূমপায়ীদের মধ্যে প্রায়শই কাশি হতে পারে, তবে যদি কাশি হঠাৎ করে তীব্র হয় এবং দীর্ঘদিন থাকে, তাহলে এটি ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • বুকের ব্যথা: যদি বুকের মাঝখানে বা পাশে ব্যথা হয় এবং এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বাড়ে, তাহলে এটি একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে।
  • শ্বাসকষ্ট: স্বাভাবিক কাজ করার সময়ও শ্বাসকষ্ট হলে এটি ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • রক্তক্ষরণ: কাশির সাথে যদি রক্ত আসে, তাহলে এটি একটি গুরুতর লক্ষণ এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
  • ওজন কমে যাওয়া: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে ওজন কমে গেলে এটি ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • ভয়েস পরিবর্তন: গলার স্বর পরিবর্তন বা ক্রমাগত কণ্ঠস্বর ভাঙ্গা ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • ক্লান্তি: স্বাভাবিক কাজ করার পরও যদি অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব হয়, তাহলে এটি একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে।

কোন বয়সের মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি

ফুসফুসের ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ যা বয়সভেদে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে দেখা যায়।

শিশু ও কিশোর-কিশোরী (০-২০ বছর)

এই বয়সের শিশু ও কিশোর কিশোরীদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক কারণ বা পরিবেশগত কারণে ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই বয়সে প্রধানত অন্য ধরনের ফুসফুসের অসুখ হতে পারে, যেমন অ্যাজমা বা ব্রংকাইটিস।

তরুণ-তরুণী (২০-৪০ বছর)

তরুণদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়, তবে এটি এখনও তুলনামূলকভাবে কম। এই বয়সের মধ্যে ধূমপান শুরু করলে বা বায়ু দূষণের সংস্পর্শে থাকলে ভবিষ্যতে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তাছাড়া যদি কেউ পারিবারিকভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তাহলে এই বয়সেই সতর্ক হওয়া উচিত।

মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্ক (৪০-৬০ বছর)

এই বয়সের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখ করার মত। ধূমপান, বায়ু দূষণ, এবং আসবেস্টসের মতো ক্ষতিকর পদার্থের সংস্পর্শ এই ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাছাড়া এই বয়সে ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী অসুখ যেমন COPD (Chronic Obstructive Pulmonary Disease) হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক (৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব)

৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ফুসফুসের ক্যান্সারের রোগীদের বেশিরভাগই এই বয়সের মধ্যে থাকে। ধূমপান, বায়ু দূষণ, এবং বয়সজনিত শারীরিক দুর্বলতা এই ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়

ফুসফুসের ক্যান্সার কিছু সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

১. ধূমপান ছাড়ুন

ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। তামাকের ধোঁয়া ফুসফুসের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

কিভাবে ধূমপান ছাড়বেন:

  • প্রথমে মনস্থির করুন: ধূমপান ছাড়ার জন্য মনস্থির করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
  • সহজ উপায়ে শুরু করুন: ধীরে ধীরে ধূমপান কমান এবং একসময় পুরোপুরি বন্ধ করুন।
  • সমর্থন গ্রহণ করুন: পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন নিন।
  • পরামর্শ গ্রহণ করুন: যদি ধূমপান ছাড়তে কষ্ট হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

২. সুস্থ খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন

সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। আপনার খাদ্য তালিকায় প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার রাখুন।

কিছু পুষ্টিকর খাদ্য:

  • শাকসবজি: ব্রকোলি, পালং শাক, ক্যারট ইত্যাদি।
  • ফলমূল: আপেল, বেরি, কমলালেবু।
  • প্রোটিন: মাছ, চিকেন, ডাল।
  • পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটমিল।

৩. বায়ু দূষণ থেকে বাঁচুন

বায়ু দূষণ ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চল ও বড় শহরে বাস করলে এই ঝুঁকি বেশি থাকে।

বায়ু দূষণ থেকে বাঁচার উপায়:

  • বায়ু পরিশোধক ব্যবহার: ঘরের ভেতরে বায়ু পরিশোধক ব্যবহার করুন এটি বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করে।
  • মাস্ক পরুন: বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক পরুন, বিশেষ করে যখন বায়ুর গুণমান খারাপ থাকে।
  • গাছ লাগান: গাছ পরিবেশকে পরিস্কার রাখতে সাহায্য করে।

৪. নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরকে সুস্থ রাখে। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

কিছু কার্যকর শারীরিক ব্যায়াম:

  • হাঁটা: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন।
  • জগিং বা দৌড়ানো: সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন জগিং বা দৌড়ানোর অভ্যাস করুন।
  • যোগব্যায়াম: যোগম্যায়াম করুন, এটি মন এবং শরীর দুটোই সুস্থ রাখে।

৫. রেডন গ্যাস থেকে বাঁচুন

রেডন গ্যাস বাড়ির ভিতরে জমা হলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। এটি মাটির নিচে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায়।

রেডন গ্যাস থেকে বাঁচার উপায়:

  • রেডন গ্যাসের পরীক্ষা: বাড়ির নিচে রেডন গ্যাসের পরীক্ষা করান। প্রয়োজন হলে রেডন মিটার ব্যবহার করুন।
  • বায়ু চলাচল: বাড়ির নিচতলায় ভালো বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।

৬. আসবেস্টস থেকে দূরে থাকুন

আসবেস্টস একটি প্রাকৃতিক খনিজ যা মাটি এবং পাথরের মধ্যে পাওয়া যায়। আসবেস্টস ফাইবারের সংস্পর্শে থাকলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।

আসবেস্টস থেকে বাঁচার উপায়:

  • আসবেস্টস মুক্ত পণ্য ব্যবহার করুন: নির্মাণ সামগ্রী এবং অন্যান্য পণ্যে আসবেস্টসমুক্ত পণ্য ব্যবহার করুন।
  • প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরুন: কাজ করার সময় আসবেস্টসের সংস্পর্শে থাকলে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক এবং মাস্ক ব্যবহার করুন।

ফুসফুসের ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, কিন্তু সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। উপরের লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতে, তাই আজ থেকেই সঠিক জীবনধারা মেনে চলুন এবং সুস্থ থাকুন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024