কোলন ক্যান্সার আমাদের হজমতন্ত্রের একটি মারাত্মক রোগ।

কোলন ক্যান্সার কি?

কোলন ক্যান্সার হল বৃহৎ অন্ত্রের (কোলন) ক্যান্সার। এটি কোলনের অভ্যন্তরীণ স্তরের কোষগুলোতে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। শুরুতে এটি ছোট পলিপ হিসেবে থাকে, যা পরে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে।

কেন কোলন ক্যান্সার হয়?

কোলন ক্যান্সারের কিছু প্রধান কারণ নিচে দেওয়া হলো:

  • জেনেটিক ফ্যাক্টর: যদি আপনার পরিবারের কারও কোলন ক্যান্সার থাকে, তাহলে আপনারও এর ঝুঁকি থাকে।
  • খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ চর্বিযুক্ত এবং লো ফাইবারযুক্ত খাদ্যাভ্যাস কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল: ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • বয়স: ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
  • শারীরিক অ্যাকটিভিটি কম হওয়া: দৈনন্দিন জীবনে শারীরিক ব্যায়াম, হাটাচলা কম হলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ

কোলন ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে যা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ হয়। নিচে কোলন ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ দেওয়া হলো:

  • মলত্যাগের পরিবর্তন: মলত্যাগের সময় বা ধরণে হঠাৎ পরিবর্তন, যেমন ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
  • রক্তমিশ্রিত মল: মলে রক্ত দেখা গেলে এটি কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • পেটব্যথা ও অস্বস্তি: পেটে অস্বস্তি, ব্যথা বা ক্র্যাম্প।
  • ওজন কমে যাওয়া: কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওজন কমে গেলে এটি ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি: সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব করা।
  • অসম্পূর্ণ মলত্যাগ: মলদ্বারে মলত্যাগ করার পরেও অসম্পূর্ণতার অনুভূতি।

বয়সভেদে কোলন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা

কোলন ক্যান্সার একটি মারাত্মক রোগ যা বয়সভেদে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে দেখা যায়। 

শিশু ও কিশোর-কিশোরী (০-২০ বছর)

এই বয়সের মধ্যে কোলন ক্যান্সার খুবই বিরল। তবে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক পরিস্থিতি যেমন ফ্যামিলিয়াল অ্যাডেনোমেটাস পলিপোসিস (FAP) বা হেরেডিটারি ননপলিপোসিস কোলোরেক্টাল ক্যান্সার (HNPCC) থাকলে ঝুঁকি বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে কোলন ক্যান্সার খুব অল্প বয়সেই হতে পারে।

তরুণ-তরুণী (২০-৪০ বছর)

তরুণদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। তবে, এই বয়সে যারা জেনেটিক সমস্যার কারণে ঝুঁকিতে থাকে তাদের মধ্যে কোলন ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাছাড়া, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা এই বয়সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, কম ফাইবারযুক্ত খাদ্যাভ্যাস এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্ক (৪০-৬০ বছর)

এই বয়সের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।

কেন ঝুঁকি বেড়ে যায়:

  • জেনেটিক ফ্যাক্টর: যদি পরিবারের কারও কোলন ক্যান্সার থাকে, তাহলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
  • খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর চর্বিযুক্ত এবং কম ফাইবারযুক্ত খাবার কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
  • অ্যাকটিভিটি কম হওয়া: শারীরিক কার্যকলাপ কম হলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক (৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব)

৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এই বয়সে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

ঝুঁকি কমানোর উপায়:

  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: এই বয়সে নিয়মিত কোলনস্কোপি বা অন্যান্য পরীক্ষা করিয়ে নিন।
  • সুস্থ খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার, প্রচুর শাকসবজি এবং ফলমূল খাওয়া।
  • ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার: ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান এড়িয়ে চলা।
  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করা।

কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়

কিছু সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কোলন ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। 

১. সুস্থ খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন

কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার খাদ্য তালিকায় প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, এবং উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবার রাখুন।

কিছু পুষ্টিকর খাদ্য:

  • শাকসবজি: ব্রকোলি, পালং শাক, ক্যারট, বাঁধাকপি ইত্যাদি।
  • ফলমূল: আপেল, বেরি, কমলালেবু, কলা।
  • পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটমিল, গোটা গমের রুটি।
  • প্রোটিন: মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, বাদাম।

ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং কোলনকে সুরক্ষিত রাখে। এছাড়া উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

২. প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন

প্রক্রিয়াজাত এবং সংরক্ষিত খাবার কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এসব খাবারে কেমিক্যাল, প্রিজারভেটিভ এবং অতিরিক্ত চিনি ও লবণ থাকে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

এড়িয়ে চলুন:

  • প্রক্রিয়াজাত মাংস: সসেজ, হটডগ, বেকন।
  • ফাস্ট ফুড: বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
  • প্যাকেটজাত খাবার: চিপস, ক্যান্ডি, প্রক্রিয়াজাত স্ন্যাকস।

৩. নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ব্যায়াম করলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং হজম প্রক্রিয়া উন্নত হয়।

কিছু কার্যকর শারীরিক কার্যকলাপ:

  • হাঁটা: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন।
  • জগিং বা দৌড়ানো: সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন জগিং বা দৌড়ানোর অভ্যাস করুন।
  • যোগব্যায়াম: এটি মন এবং শরীর দুটোই সুস্থ রাখে।

৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু টিপস:

  • অল্প পরিমানে খাওয়া: বেশি পরিমান খাবার একসাথে আহার না করে, অল্প অল্প করে দিনে কয়েকবার খান।
  • পানি পান করুন: পর্যাপ্ত পানি পান করুন যা হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
  • কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খান: ফলমূল এবং শাকসবজি বেশি খান।

৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলো ত্যাগ করলে কেবল কোলন ক্যান্সার নয়, অন্যান্য অনেক রোগের ঝুঁকিও কমে যায়।

কিভাবে ছাড়বেন:

  • ধীরে ধীরে ছাড়ুন: হঠাৎ ছাড়ার পরিবর্তে ধীরে ধীরে কমান।
  • সাহায্য নিন: পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্য ও সমর্থন নিন।
  • পরামর্শ গ্রহণ করুন: প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান

কোলন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে চিকিৎসা সহজ হয়। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

স্বাস্থ্য পরীক্ষার ধরন:

  • কোলনস্কোপি: কোলন ক্যান্সার শনাক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা।
  • রক্ত পরীক্ষা: নির্দিষ্ট কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করা যায়।

কোলন ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। উপরের প্রতিরোধমূলক উপায়গুলো মেনে চলুন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হাতে, তাই আজ থেকেই সঠিক জীবনধারা মেনে চলুন এবং সুস্থ থাকুন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024