ওভারিয়ান ক্যান্সার, বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, নারীদের মধ্যে একটি প্রচলিত ক্যান্সার যা বিভিন্ন বয়সে হতে পারে।

ওভারিয়ান ক্যান্সার কি?

ওভারিয়ান ক্যান্সার হল ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার। ডিম্বাশয় হলো মহিলাদের প্রজনন অঙ্গ, যা জরায়ুর উভয় পাশে থাকে। এই ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হয় এবং হরমোনও উৎপন্ন হয়। ওভারিয়ান ক্যান্সার তখন হয় যখন ডিম্বাশয়ের কোষগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং টিউমার তৈরি করে।

কেন হয়?

ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার কিছু প্রধান কারণ হচ্ছে:

  • বংশগত কারণ: পরিবারের ইতিহাসে যদি কারো ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকে, তাহলে ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে যদি মা, বোন বা মেয়ের ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকে।
  • বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষত, ৫০ বছর বা তার উপরের নারীদের এই ক্যান্সার বেশি দেখা যায়।
  • হরমোন থেরাপি: মেনোপজ পরবর্তী সময়ে হরমোন থেরাপি নিলে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
  • প্রজনন ইতিহাস: যেসব নারীরা কখনও গর্ভবতী হননি তাদের ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি একটু বেশি থাকে।
  • জীবনযাপন: ওজনাধিক্য, ধূমপান, এবং খাদ্যাভ্যাসে ফাইবার কম থাকা ও ফ্যাট বেশি থাকা ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

লক্ষণ গুলো কি কি?

ওভারিয়ান ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে, যেগুলো অন্য অনেক সাধারণ সমস্যার সাথেও মিলে যেতে পারে। তবে নিয়মিত এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  • পেটের ফাঁপা ভাব: প্রায়ই পেট ফাঁপা লাগা, যা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে।
  • পেটের নীচের অংশে ব্যথা: ডিম্বাশয়ের আশেপাশে, বিশেষ করে তলপেটে ক্রমাগত ব্যথা বা অস্বস্তি।
  • খাবারে অরুচি বা অল্প খাওয়ার পরেও পূর্ণতা অনুভব: খুব অল্প খাবার খেলেও পেট ভর্তি লাগা বা খেতে ইচ্ছা না করা।
  • বারবার প্রস্রাবের প্রয়োজন: প্রস্রাবের সময়ে ব্যথা বা খুব ঘন ঘন প্রস্রাব করতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা।
  • ওজন কমে যাওয়া: কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন কমে যাওয়া।
  • মলত্যাগের সমস্যা: পেটের মলত্যাগে সমস্যা হওয়া, বিশেষ করে কোষ্ঠকাঠিন্য।

ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা 

কোন কোন বয়সের নারীদের ওভারিয়ান ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি এবং কেন।

কিশোরী এবং তরুণ বয়স (১৩-২০ বছর)

এই বয়সে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি খুবই কম। তবে, খুব কম হলেও কিছু ক্ষেত্রে এই বয়সের মেয়েদের ডিম্বাশয়ের টিউমার দেখা যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই টিউমারগুলো ম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সারযুক্ত) হয় না।

যুবতী ও মধ্যবয়সী নারীরা (২০-৫০ বছর)

২০-৫০ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি একটু বেশি। বিশেষত, যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করেন না এবং যাদের পরিবারে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ইতিহাস আছে তাদের ঝুঁকি বেশি থাকে। এই বয়সে, নারীদের প্রজনন ক্ষমতা বেশি থাকে এবং হরমোনের পরিবর্তনশীলতা বেশি থাকে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

মধ্যবয়সী ও বয়স্ক নারীরা (৫০ বছর এবং তার উপরে)

৫০ বছর এবং তার উপরের নারীদের মধ্যে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। মেনোপজ পরবর্তী সময়ে এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ হল মেনোপজের পর ডিম্বাশয়ের কার্যকলাপ কমে যায় এবং কোষের পরিবর্তন বেশি হয়। এ ছাড়া, যারা মেনোপজ পরবর্তী হরমোন থেরাপি নেন তাদের ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে।

বয়সভিত্তিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ

৫০ বছরের নিচে:

  • প্রজনন বয়স: এই বয়সে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কম, তবে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া যায় না।
  • পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের মধ্যে কারও যদি ওভারিয়ান ক্যান্সার থাকে, তাহলে ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে।

৫০-৬০ বছর:

  • মেনোপজ শুরুর সময়: এই বয়সে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে শুরু করে।
  • হরমোন থেরাপি: মেনোপজ পরবর্তী হরমোন থেরাপি গ্রহণকারীদের মধ্যে ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে।

৬০ বছরের উপরে:

  • উচ্চ ঝুঁকি: এই বয়সে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় 

কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস এই ঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু উপায়।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: খাদ্যাভ্যাসে বেশি করে ফাইবার যুক্ত করুন। সবজি, ফলমূল, এবং পূর্ণ শস্য খাদ্যাভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত করুন। ফাইবার হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বেরি, বাদাম, পালংশাক, ব্রকলি ইত্যাদি খাবারে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা শরীরের কোষগুলিকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
  • চর্বি কমানো: খাদ্যাভ্যাসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট কম রাখুন। স্বাস্থ্যকর চর্বি যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন মাছ, আখরোট, এবং অলিভ অয়েল।
  • প্রচুর পানি পান করুন: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি। এটি শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে এবং কোষের কার্যকারিতা বাড়ায়।

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম

নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করুন। এটি আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখবে।

জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার করেন তাদের ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে। তবে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহারের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সন্তান ধারণ ও স্তন্যপান

গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা সন্তান ধারণ করেন এবং সন্তানকে স্তন্যপান করান তাদের ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। স্তন্যপান করানোর ফলে ডিম্বাশয়ের কার্যকলাপ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

পারিবারিক ইতিহাস জানা

যদি আপনার পরিবারে ওভারিয়ান ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাহলে আপনার ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে। এই ক্ষেত্রে, আপনাকে আরও সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। জিনগত পরীক্ষা করিয়ে ঝুঁকি নির্ণয় করা যেতে পারে।

ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন ওভারিয়ান ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই এই অভ্যাসগুলি থেকে বিরত থাকুন।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করতে সাহায্য করে। পেলভিক পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্ণয় করা যায়।

ওভারিয়ান ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম, এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এই ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, আপনার স্বাস্থ্য সবার আগে, তাই নিজের প্রতি যত্নশীল হোন এবং সঠিক সময়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024