লুজ মোশন, যা আমরা ডায়রিয়া নামেও জানি, হলো একটি স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে আপনার মল (স্টুল) পাতলা ও পানি যুক্ত হয় এবং ঘন ঘন মলত্যাগের প্রবণতা দেখা দেয়। সাধারণত, লুজ মোশন একটি সাময়িক সমস্যা, কিন্তু এটি কখনও কখনও গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সংকেত হতে পারে।

লুজ মোশনের কারণগুলি

লুজ মোশন বিভিন্ন কারণে হতে পারে, এখানে কিছু প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:

ভাইরাসজনিত সংক্রমণ: সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। রোটাভাইরাস, নরোভাইরাস ইত্যাদি ভাইরাসগুলো লুজ মোশন সৃষ্টি করতে পারে। এই সংক্রমণগুলো সাধারণত নোংরা পানীয় বা খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ: ব্যাকটেরিয়া যেমন ই-কোলাই, স্যালমোনেলা এবং শিগেলা ইত্যাদি লুজ মোশন সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ সাধারণত নোংরা খাবার বা পানীয় থেকে ছড়ায়।

পরজীবী সংক্রমণ: পরজীবী যেমন অ্যামিবিয়া এবং জিআরডিয়া সংক্রমণও লুজ মোশনের কারণ হতে পারে। এই পরজীবীগুলোও নোংরা পানীয় বা খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।

খাদ্য অ্যালার্জি বা অ-সহিষ্ণুতা: কিছু খাবারের অ্যালার্জি বা অ-সহিষ্ণুতা থেকেও লুজ মোশন হতে পারে। যেমন, ল্যাকটোজ অ-সহিষ্ণুতার কারণে দুধ বা দুধের পণ্য খেলে লুজ মোশন হতে পারে।

মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: কিছু ওষুধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, লুজ মোশন সৃষ্টি করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি আমাদের অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকেও ধ্বংস করতে পারে, ফলে লুজ মোশন হতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন: অনেক সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লুজ মোশন হতে পারে। এটি সাধারণত ট্র্যাভেলার্স ডায়রিয়া নামে পরিচিত।

স্ট্রেস ও উদ্বেগ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগও লুজ মোশন সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের অন্ত্র এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি জোরালো সংযোগ রয়েছে, ফলে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন অন্ত্রের কার্যক্রমেও প্রভাব ফেলে।

অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা: অনিয়মিত খাবার, নোংরা পানি পান, অপরিষ্কার পরিবেশে থাকা ইত্যাদি কারণেও লুজ মোশন হতে পারে।

লুজ মোশনের লক্ষণ কি কি?

লুজ মোশন এর লক্ষণগুলো বুঝতে পারলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয়। লুজ মোশনের লক্ষণগুলি নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. ঘন ঘন মলত্যাগ

লুজ মোশনের প্রধান লক্ষণ হলো ঘন ঘন মলত্যাগ। সাধারণত, একজন সুস্থ ব্যক্তির দিনে ১-২ বার মলত্যাগ করা স্বাভাবিক। কিন্তু লুজ মোশনের সময় এই সংখ্যা অনেক বেড়ে যেতে পারে, এবং দিনে ৫-১০ বার বা তারও বেশি মলত্যাগ হতে পারে।

২. পাতলা ও পানি যুক্ত মল

লুজ মোশনের আরেকটি প্রধান লক্ষণ হলো মল পাতলা ও পানি যুক্ত হয়। মলের গঠন পরিবর্তিত হয়ে তরল হয়ে যায় এবং এতে পানি মিশ্রিত থাকে।

৩. পেট ব্যথা ও ক্র্যাম্প

লুজ মোশনের সময় পেট ব্যথা ও ক্র্যাম্প সাধারণ লক্ষণ। পেটের নীচের অংশে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা বেশিরভাগ সময় মলত্যাগের আগে বা পরে হয়।

৪. বমি ভাব ও বমি

অনেক সময় লুজ মোশনের সাথে বমি ভাব বা বমি হতে পারে। এটি সাধারণত খাদ্য বিষক্রিয়া বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ঘটে।

৫. ফ্ল্যাটুলেন্স বা পেট ফাঁপা

লুজ মোশনের সময় পেটে গ্যাস জমে পেট ফাঁপা হতে পারে। এটি একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।

৬. জ্বর

যদি লুজ মোশন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে হয়, তাহলে জ্বরও হতে পারে। সাধারণত, উচ্চ তাপমাত্রা এবং শরীরে কমজোরি অনুভব করা হয়।

৭. পানি শূন্যতা

লুজ মোশনের সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়, যা পানি শূন্যতার (ডিহাইড্রেশন) কারণ হতে পারে। এর ফলে মুখ শুকিয়ে যাওয়া, তৃষ্ণা, কম প্রস্রাব হওয়া, এবং ত্বকের শুষ্কতা দেখা দেয়।

৮. ক্লান্তি ও দুর্বলতা

লুজ মোশনের সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে তরল বেরিয়ে যায়, ফলে শরীর ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। শক্তি কমে যায় এবং কাজ করার ইচ্ছা থাকে না।

৯. রক্ত মিশ্রিত মল

কিছু ক্ষেত্রে লুজ মোশনের সময় মলে রক্ত দেখা যেতে পারে। এটি একটি গুরুতর লক্ষণ হতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

১০. ওজন কমে যাওয়া

লুজ মোশন দীর্ঘস্থায়ী হলে ওজন কমে যেতে পারে। শরীর থেকে পুষ্টি শোষণ কমে যায়, ফলে ওজন কমতে থাকে।

কিভাবে লুজ মোশন বন্ধ করবেন?

লুজ মোশন বন্ধ করার কিছু কার্যকর পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

লুজ মোশনের সময় শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়, যা পানি শূন্যতার (ডিহাইড্রেশন) কারণ হতে পারে। তাই, প্রচুর পানি পান করতে হবে। আপনি স্যালাইন পানি, নারকেল পানি, বা ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানীয় পান করতে পারেন, যা শরীরের তরল ও ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

২. বিশ্রাম নিন

লুজ মোশনের সময় শরীরের অতিরিক্ত ক্লান্তি এবং দুর্বলতা দেখা দেয়। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং শরীরকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ দিন।

৩. সহজপাচ্য খাবার খান

লুজ মোশনের সময় সহজপাচ্য খাবার খান, যা হজম করা সহজ। এই ধরনের খাবারগুলি অন্ত্রের উপর কম চাপ ফেলে এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। যেমন:

  • খিচুড়ি
  • চিড়া ভেজানো
  • টোস্ট
  • কলা

৪. প্রোবায়োটিক গ্রহণ করুন

প্রোবায়োটিক হল উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। দই, বাটারমিল্ক, বা প্রোবায়োটিক সম্পূরক গ্রহণ করতে পারেন, যা লুজ মোশন বন্ধ করতে সাহায্য করবে।

৫. খাবার থেকে বিরত থাকুন

কিছু খাবার লুজ মোশনকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন:

  • দুগ্ধজাত পণ্য
  • চর্বিযুক্ত খাবার
  • মশলাদার খাবার
  • ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল

এই ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন যতক্ষণ না আপনার লুজ মোশন পুরোপুরি ঠিক হয়।

৬. আদা ও মধুর ব্যবহার

আদা একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা লুজ মোশন কমাতে সাহায্য করে। আদার রস এবং মধু মিশিয়ে পান করুন। এটি অন্ত্রের প্রদাহ কমিয়ে দেয় এবং হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখে।

৭. পুদিনা পাতা

পুদিনা পাতা লুজ মোশন কমাতে সাহায্য করে। পুদিনা পাতার রস এবং এক চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন। এটি অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৮. আপেল সিডার ভিনেগার

আপেল সিডার ভিনেগার একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান। এক গ্লাস পানিতে এক চামচ আপেল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করুন। এটি অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

৯. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

যদি লুজ মোশন তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয় বা মলে রক্ত দেখা যায়, তৎক্ষণাৎ একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এছাড়া, যদি শিশু বা বৃদ্ধদের লুজ মোশন হয়, তাহলে তাদের জন্যও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

লুজ মোশন সাধারণত তেমন কোনো বড় সমস্যা নয়, তবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এটি দ্রুত নিরাময় হয় এবং শরীর সুস্থ হয়। সঠিক পুষ্টি এবং বিশ্রাম নিশ্চিত করে আপনি লুজ মোশন থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারেন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024