রেকটাল ক্যান্সার হলো এক ধরণের ক্যান্সার যা মলাশয়ের নিচের অংশ, অর্থাৎ রেকটামে তৈরি হয়। রেকটাল ক্যান্সারকে কখনো কখনো কোলোরেক্টাল ক্যান্সারও বলা হয়, কারণ এটি কোলন এবং রেকটামের মধ্যে সম্পর্কিত। রেকটাল ক্যান্সার সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো তেমন দেখা যায় না। তবে সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি মারাত্মক হতে পারে।

কী কারণে রেকটাল ক্যান্সার হতে পারে?

রেকটাল ক্যান্সার মলাশয়ের নিচের অংশে তৈরি হয় এবং এটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। রেকটাল ক্যান্সারের কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:

১. খাদ্যাভ্যাস

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে ফাইবার কম এবং চর্বি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়ার কারণে রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। প্রক্রিয়াজাত মাংস, যেমন সসেজ, বেকন, এবং হট ডগের অতিরিক্ত সেবনও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

২. স্থূলতা

অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার এবং কম শারীরিক কার্যকলাপের কারণে স্থূলতা হতে পারে, যা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

৩. শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা

নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ না করলে রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। ব্যায়াম হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সহায়ক এবং মলাশয়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

৪. বংশগতির প্রভাব

পরিবারের কারো রেকটাল ক্যান্সার থাকলে অন্য সদস্যদেরও এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিছু নির্দিষ্ট জিনগত পরিবর্তন এবং বংশগত রোগ, যেমন ফ্যামিলিয়াল অ্যাডেনোম্যাটাস পলিপোসিস (FAP) এবং লিঞ্চ সিনড্রোম, রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৫. ধূমপান ও অ্যালকোহল

ধূমপান ও অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের কারণে কেমিক্যাল মলাশয়ের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।

রেকটাল ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কি?

রেকটাল ক্যান্সারের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা সঠিক সময়ে চিনতে পারলে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে এই ক্যান্সার নিরাময় সম্ভব হতে পারে। নিচে রেকটাল ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:

১. মলের সঙ্গে রক্তপাত

রেকটাল ক্যান্সারের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হলো মলের সঙ্গে রক্তপাত। অনেক সময় মলে রক্ত দেখতে পাওয়া যায় যা ক্যান্সারের ইঙ্গিত দিতে পারে।

২. পেট ব্যথা

পেটের নিচের অংশে বা রেকটামের আশেপাশে ক্রমাগত ব্যথা অনুভব হলে তা রেকটাল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এই ব্যথা অনেক সময় তীব্র হতে পারে এবং প্রতিদিনের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

৩. মলত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন

মলত্যাগের অভ্যাসে হঠাৎ পরিবর্তন, যেমন ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, বা মলের আকারে পরিবর্তন, রেকটাল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ লাগা বা অসম্পূর্ণ অনুভূতি হতে পারে।

৪. মলের আকার পরিবর্তন

মলের আকার পরিবর্তন, যেমন মল পাতলা বা ফিতের মতো হয়ে যাওয়া, রেকটাল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। এটি রেকটামে টিউমার বা বাধার কারণে হতে পারে।

৫. অকারণে ওজন কমে যাওয়া

অকারণে হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া অনেক সময় ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। রেকটাল ক্যান্সার শরীরের পুষ্টি শোষণ করতে সমস্যা সৃষ্টি করে, যা ওজন কমার কারণ হতে পারে।

৬. অবিরাম ক্লান্তি

রেকটাল ক্যান্সারের কারণে শরীর ক্লান্ত ও দুর্বল অনুভব করতে পারে। শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে, যা ক্লান্তির কারণ হতে পারে।

৭. অ্যানিমিয়া

রেকটাল ক্যান্সারের কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতে পারে, যা রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় এবং দুর্বলতা, ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

বয়সভেদে রেকটাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা

রেকটাল ক্যান্সার যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের এই ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিচে বয়সভেদে রেকটাল ক্যান্সারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. কিশোর ও তরুণ

  • ২০-৪০ বছর: এই বয়সে রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে পরিবারের ইতিহাস থাকলে এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে ঝুঁকি বাড়তে পারে।

২. মধ্যবয়স্ক

  • ৪১-৬০ বছর: এই বয়সে রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে শুরু করে। স্থূলতা, ধূমপান, এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে এই বয়সে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৩. বৃদ্ধ

  • ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে: এই বয়সে রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্থূলতা, এবং ধূমপানের কারণে এই বয়সে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।

রেকটাল ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়গুলো কি কি?

রেকটাল ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, যা আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। একজন পুষ্টিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে, রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর কিছু কার্যকর উপায় নিচে আলোচনা করা হলো:

১. সুষম খাদ্যগ্রহণ

সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। কিছু খাদ্যাভ্যাস নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য: প্রতিদিন পর্যাপ্ত ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। ফাইবার মল নরম রাখতে সাহায্য করে এবং মলত্যাগের অভ্যাস নিয়মিত রাখতে সহায়ক। সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, ব্রাউন রাইস, ওটমিল, এবং গোটা গমের রুটি খাদ্যাভ্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
  • ফলমূল ও সবজি: প্রচুর ফলমূল ও সবজি খাওয়া উচিত, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। আপেল, কলা, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, গাজর, টমেটো ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য: মাছ, মুরগির মাংস, ডাল, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়া উচিৎ, যা শরীরের কোষ গঠনে সহায়ক।

২. নিয়মিত ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং, এবং যোগব্যায়াম ইত্যাদি ব্যায়ামের মধ্যে রাখা যেতে পারে।

৩. পর্যাপ্ত পানি পান

প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা উচিত, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং মল নরম করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত।

৪. সঠিক ওজন বজায় রাখা

সঠিক ওজন বজায় রাখা রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে সঠিক ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

৫. তামাক ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা

তামাক এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান ও চিউইং টোব্যাকো ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা রেকটাল ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে সহায়ক। ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্য কলোনোস্কপি পরীক্ষা করা উচিত।

৭. ভিটামিন ও খনিজ

ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। দুধ, দই, চিজ, পালং শাক, ব্রকলি ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।

৮. মানসিক চাপ কমানো

মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত ধ্যান বা যোগব্যায়াম করা উচিত। মানসিক চাপ শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

রেকটাল ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য সঠিক পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার এবং আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য এই পরামর্শগুলো মেনে চলুন এবং সুস্থ থাকুন। যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024