মেরুদন্ডের ক্যান্সার হলো এক ধরনের ক্যান্সার যা মেরুদন্ড বা স্পাইনাল কর্ডে তৈরি হয়। এটি মেরুদন্ডের হাড়, মজ্জা বা স্নায়ুতে অস্বাভাবিক কোষের বর্ধনের ফলে ঘটে। মেরুদন্ডের ক্যান্সার প্রাথমিক (যা সরাসরি মেরুদন্ডে শুরু হয়) বা মাধ্যমিক (যা শরীরের অন্য কোনো অংশ থেকে মেরুদন্ডে ছড়ায়) হতে পারে। মেরুদন্ডের ক্যান্সার দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং মেরুদন্ডের আশেপাশের কোষ ও টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কী কারণে মেরুদন্ডের ক্যান্সার হয়
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের সঠিক কারণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান রয়েছে যা মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো:
১. বংশগতির প্রভাব
পরিবারের কারো পূর্বে মেরুদন্ডের ক্যান্সার হয়ে থাকলে পরবর্তি প্রজন্মে অন্য সদস্যদেরও এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। জিনগত পরিবর্তন এবং বংশগতির কারণেও এই ক্যান্সার হতে পারে।
২. রেডিয়েশন
শরীরের অন্য অংশে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি নিলে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি।
৩. বয়স
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে ৪০ বছরের উর্ধ্বে এই ঝুঁকি বেশি থাকে।
৪. ভিটামিনের ঘাটতি
শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়ামের অভাব হলে হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। পুষ্টিহীন খাদ্যাভ্যাস এই ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৫. ভ্যাক্সিন ও সংক্রমণ
কিছু নির্দিষ্ট ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। যেমন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) এবং এপস্টাইন-বার ভাইরাস (EBV)।
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি কি?
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে এবং এটি মেরুদন্ডের কোন অংশে ক্যান্সার হয়েছে তার উপর নির্ভর করে। নিচে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
১. পিঠে ব্যথা
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো পিঠে তীব্র ব্যথা। এই ব্যথা সাধারণত রাতে বা বিশ্রামের সময় বেশি হয় এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ব্যথা কখনো কখনো পায়ে বা হাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২. দুর্বলতা
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণে পায়ে বা হাতে দুর্বলতা অনুভব হতে পারে। চলাফেরা করতে বা ভারী কাজ করতে সমস্যা হতে পারে।
৩. সংবেদনশীলতার পরিবর্তন
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে সংবেদনশীলতার পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, হাতে বা পায়ে ঝিঁঝি ধরা, অনুভূতি কমে যাওয়া বা বেশি সংবেদনশীল হয়ে যাওয়া।
৪. হাঁটা বা চলাচলে সমস্যা
মেরুদন্ডের ক্যান্সার মেরুদন্ডের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা চলাচলের সমস্যা তৈরি করতে পারে। হাঁটতে বা চলতে সমস্যা হতে পারে।
৫. মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগের সমস্যা
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণে মূত্রত্যাগ ও মলত্যাগের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সমস্যা হতে পারে। মূত্রথলি বা অন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে।
৬. পেশীতে খিঁচুনি
মেরুদন্ডের ক্যান্সারের কারণে পেশীতে খিঁচুনি বা খিঁচুনি অনুভব হতে পারে। এটি সাধারণত পিঠে, পায়ে বা হাতে ঘটে।
৭. ওজন কমে যাওয়া
অকারণে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া মেরুদন্ডের ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে।
বয়সভেদে মেরুদন্ডের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা
মেরুদন্ডের ক্যান্সার যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নিচে বয়সভেদে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
শিশু ও কিশোর
- ০-১৯ বছর: শিশু ও কিশোরদের মধ্যে মেরুদন্ডের ক্যান্সার সাধারণত কম হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট প্রকারের ক্যান্সার, যেমন মেডুলোব্লাস্টোমা এবং ইওয়িংস সারকোমা, এই বয়সে দেখা যায়।
তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্ক
- ২০-৪০ বছর: এই বয়সে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে এই বয়সে স্নায়ুর কোষে এবং মজ্জার টিউমার দেখা যেতে পারে।
মধ্যবয়স্ক
- ৪১-৬০ বছর: এই বয়সে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে প্রাইমারি মেরুদন্ডের টিউমার, যেমন মেনিঙ্গিওমা এবং সোয়ান্নোমা, এই বয়সে বেশি দেখা যায়।
বৃদ্ধ
- ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে: এই বয়সে মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে মেটাস্ট্যাটিক টিউমার, যা শরীরের অন্য অংশ থেকে মেরুদন্ডে ছড়ায়, এই বয়সে বেশি দেখা যায়।
মেরুদন্ডের ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়গুলো কি কি?
মেরুদন্ডের ক্যান্সার প্রতিরোধের কোনো নির্দিষ্ট উপায় নেই, তবে কিছু অভ্যাস ও জীবনধারা মেনে চললে এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর কিছু কার্যকর উপায় নিচে আলোচনা করা হলো:
১. সুষম খাদ্যগ্রহণ
স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। কিছু পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম: হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যেমন দুধ, দই, চিজ, পালং শাক, ব্রকলি ইত্যাদি।
- ফলমূল ও সবজি: প্রচুর ফলমূল ও সবজি খেতে হবে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। যেমন আপেল, কলা, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, গাজর, টমেটো ইত্যাদি।
- পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটমিল, গোটা গমের রুটি ইত্যাদি খেতে হবে, যা ফাইবার সমৃদ্ধ।
২. তামাক ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকা
তামাক এবং অ্যালকোহল মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান ও চিউইং টোব্যাকো ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং মেরুদন্ডের কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সহায়ক। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত। যেমন হাঁটা, দৌড়ানো, যোগব্যায়াম ইত্যাদি।
৪. পর্যাপ্ত পানি পান
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সহায়ক।
৫. সঠিক ওজন বজায় রাখা
সঠিক ওজন বজায় রাখা মেরুদন্ডের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে সঠিক ওজন বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত, যা শরীরের পুনরুদ্ধারে সহায়ক এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
৭. মানসিক চাপ কমানো
মানসিক চাপ কমানোর জন্য নিয়মিত ধ্যান বা যোগব্যায়াম করা উচিত। মানসিক চাপ শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৮. স্বাস্থ্যকর জীবনধারা
সুস্থ জীবনধারা মেনে চলা মেরুদন্ডের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মধ্যে রয়েছে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং সঠিক পুষ্টি ও ব্যায়াম মেনে চলা।