ভিটামিন বি১২ আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভিটামিন। এটি রক্তের লোহিত কণিকা উৎপাদনে, নার্ভ সিস্টেমের কার্যকারিতায়, এবং ডিএনএ তৈরিতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি১২ এর অভাব হলে শরীরের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

ভিটামিন বি১২ এর অভাব কি?

ভিটামিন বি১২ এর অভাব তখন হয় যখন শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ভিটামিন গ্রহণ বা শোষণ করতে পারে না। এটি সাধারণত রক্তাল্পতা, নার্ভের সমস্যা, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। ভিটামিন বি১২ এর অভাবের লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে গুরুতর হয়ে ওঠে।

ভিটামিন বি১২ এর অভাব এর কারণ গুলো কি কি?

ভিটামিন বি১২ এর অভাবের অনেক কারণ থাকতে পারে। নিচে ভিটামিন বি১২ এর অভাবের প্রধান কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:

১. খাদ্যাভ্যাসের সমস্যা

ভিটামিন বি১২ সাধারণত প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া যায়, যেমন মাংস, মাছ, ডিম, এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য। যারা সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী বা ভেগান ডায়েট অনুসরণ করেন, তাদের মধ্যে ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা দিতে পারে, কারণ তাদের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ উৎস থাকে না।

২. হজম সমস্যার কারণে শোষণ ব্যাহত হওয়া

কিছু হজম সমস্যা ভিটামিন বি১২ এর শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন:

  • পেরনিশিয়াস অ্যানিমিয়া: এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যা শরীরের পেটের একটি প্রোটিন (ইনট্রিনসিক ফ্যাক্টর) তৈরি করতে অক্ষম করে, যা ভিটামিন বি১২ শোষণে সাহায্য করে।
  • ক্লন’স ডিজিজ এবং সিলিয়াক ডিজিজ: এই রোগগুলির কারণে অন্ত্রের শোষণ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে ভিটামিন বি১২ এর শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়।

৩. বয়সজনিত কারণ

বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ভিটামিন বি১২ শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। বৃদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায়ই ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা যায়।

৪. শল্যচিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার

কিছু শল্যচিকিৎসা, যেমন গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি বা অন্ত্রের অংশ অপসারণ, ভিটামিন বি১২ এর শোষণ কমাতে পারে। এই ধরনের সার্জারির পরে রোগীদের মধ্যে ভিটামিন বি১২ এর অভাব দেখা দিতে পারে।

৫. দীর্ঘমেয়াদী ঔষধ ব্যবহার

কিছু ঔষধ, যেমন মেটফর্মিন (ডায়াবেটিসের ঔষধ) এবং প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার্স (অ্যাসিডিটির ঔষধ), দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের ফলে ভিটামিন বি১২ এর শোষণ কমাতে পারে।

৬. অ্যালকোহলিজম

অতিরিক্ত মদ্যপান ভিটামিন বি১২ এর শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এটি লিভার এবং অন্ত্রের শোষণ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়, যা ভিটামিন বি১২ এর অভাবের কারণ হতে পারে।

বয়সভেদে ভিটামিন বি 12 এর অভাব হওয়ার সম্ভাবনা

কোন বয়সের মানুষের ভিটামিন বি 12 এর অভাব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং কেন তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ঝুঁকি কম: শিশু ও কিশোর বয়স (০-১৮ বছর)

শিশু এবং কিশোর বয়সে ভিটামিন বি 12 এর অভাব সাধারণত কম দেখা যায়, কারণ এই বয়সে শরীরের মেটাবলিজম এবং শোষণ ক্ষমতা ভালো থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যদি শিশু সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী বা ভেগান হয়, তাহলে ভিটামিন বি 12 এর অভাব হতে পারে। এ ছাড়া, হজমের সমস্যাও এই বয়সে ভিটামিন বি 12 এর অভাবের কারণ হতে পারে।

ঝুঁকি মধ্যম: যুবক ও প্রাপ্তবয়স্ক বয়স (১৮-৪৫ বছর)

যুবক এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন বি 12 এর অভাবের ঝুঁকি মধ্যম। এই বয়সে সাধারণত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ ব্যবহার, এবং নিরামিষভোজী বা ভেগান ডায়েট অনুসরণের ফলে ভিটামিন বি 12 এর অভাব দেখা দিতে পারে।

  • অ্যাসিডিটির ওষুধ: প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার্স এবং অন্যান্য অ্যাসিডিটির ওষুধ দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করলে ভিটামিন বি 12 এর শোষণ কমে যায়।
  • ভেগান বা নিরামিষভোজী ডায়েট: ভেগান বা সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী ডায়েট অনুসরণের ফলে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন বি 12 এর অভাব হতে পারে, কারণ এটি প্রধানত প্রাণিজ উৎস থেকে পাওয়া যায়।

ঝুঁকি বেশি: মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ বয়স (৪৫ বছর এবং তার বেশি)

মধ্যবয়সী এবং বৃদ্ধ বয়সে ভিটামিন বি 12 এর অভাবের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

  • বয়সজনিত পরিবর্তন: বয়স বাড়ার সাথে সাথে পেটের অ্যাসিড উৎপাদন কমে যায়, যা ভিটামিন বি 12 এর শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
  • অটোইমিউন রোগ: বয়স বাড়ার সাথে সাথে পেরনিশিয়াস অ্যানিমিয়া এবং অন্যান্য অটোইমিউন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা ভিটামিন বি 12 এর শোষণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
  • গ্যাস্ট্রিক সার্জারি: গ্যাস্ট্রিক বাইপাস বা অন্ত্রের অংশ অপসারণের মতো শল্যচিকিৎসা ভিটামিন বি 12 এর শোষণ কমাতে পারে।
  • দীর্ঘমেয়াদী ঔষধ ব্যবহার: দীর্ঘমেয়াদী মেটফর্মিন (ডায়াবেটিসের ঔষধ) ব্যবহার বৃদ্ধ বয়সে ভিটামিন বি 12 এর অভাবের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ভিটামিন বি 12 এর অভাব প্রতিরোধের উপায়

ভিটামিন বি 12 এর অভাব প্রতিরোধে কিছু কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। একজন পুষ্টিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু পরামর্শ নিম্নরূপ:

১. প্রাণিজ উৎস থেকে ভিটামিন বি 12 গ্রহণ

মাংস, মাছ, ডিম, এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য খাওয়ার চেষ্টা করুন। এই ধরনের খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি 12 থাকে, যা শরীরের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে।

২. সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ

যদি খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন বি 12 পাওয়া না যায়, তবে ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন বি 12 সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। বিশেষ করে ভেগান বা নিরামিষভোজীদের জন্য ভিটামিন বি 12 সাপ্লিমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩. প্রয়োজনীয় হজম সমস্যা চিকিৎসা

যদি কোনো হজম সমস্যা থাকে, তবে তা দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা করুন। পেরনিশিয়াস অ্যানিমিয়া, ক্লন’স ডিজিজ বা সিলিয়াক ডিজিজের মতো রোগগুলির চিকিৎসা নিন।

৪. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা এবং পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং ভিটামিন শোষণ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

৫. অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা

অতিরিক্ত মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন। এটি লিভার এবং অন্ত্রের শোষণ প্রক্রিয়া ভালো রাখতে সহায়ক।

ভিটামিন বি 12 এর অভাব একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করলে এর প্রতিরোধ সম্ভব। ভিটামিন বি 12 এর অভাবের কারণগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখা সম্ভব।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024