ব্রেন টিউমার এমন একটি বিষয় যা নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভয় এবং উদ্বেগ থাকে। কিন্তু সত্যি বলতে, সঠিক তথ্য জানলে আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হতে পারি এবং কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি।
ব্রেন টিউমারের লক্ষণ
ব্রেন টিউমারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে দেখা দেয়। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
- মাথাব্যথা: নিয়মিত এবং ক্রমবর্ধমান মাথাব্যথা যা সকালে বেশি হয়।
- বমি বা বমির ভাব: বিশেষত সকালে।
- দৃষ্টিশক্তির সমস্যা: ঝাপসা দেখা, ডবল ভিশন, অথবা চোখে ব্যথা।
- শরীরের দুর্বলতা: হাত বা পায়ে দুর্বলতা, অসাড়তা বা অবশ।
- সমন্বয়ের অভাব: হাঁটতে বা চলাচল করতে সমস্যা।
- মেমোরি লস: স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা বা সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া।
- মুড সুইং: আচরণগত পরিবর্তন বা আবেগের অস্থিরতা।
- কথা বলার সমস্যা: কথা বলতে কষ্ট, বাক্য গঠন করতে সমস্যা।
ব্রেন টিউমারের ধরন
ব্রেন টিউমারকে প্রধানত দুটি বৃহৎ শ্রেণিতে ভাগ করা যায়: প্রাইমারি টিউমার এবং সেকেন্ডারি টিউমার। প্রাইমারি টিউমার মস্তিষ্কেই শুরু হয়, এবং সেকেন্ডারি টিউমার শরীরের অন্য কোথাও শুরু হয়ে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে।
(ক) প্রাইমারি ব্রেন টিউমার
প্রাইমারি ব্রেন টিউমারকে আবার দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা যায়: বিনাইন (সৌম্য) টিউমার এবং ম্যালিগন্যান্ট (দূষিত) টিউমার।
বিনাইন (সৌম্য) টিউমার:
- মেনিঙ্গিওমাস: মস্তিষ্কের আবরণী টিস্যুতে গঠিত হয়। সাধারণত এই টিউমার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং প্রায়শই সার্জারি বা রেডিয়েশনের মাধ্যমে অপসারণ করা যায়।
- পিটুইটারি অ্যাডেনোমাস: এই টিউমার পিটুইটারি গ্রন্থিতে গঠিত হয় এবং হরমোন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
- সোয়ান্নোমাস: এই টিউমার নার্ভ শিথে (নিষ্ক্রিয় নার্ভ টিস্যু) গঠিত হয় এবং সাধারণত স্নায়ুতন্ত্রের বাহিরে পাওয়া যায়।
ম্যালিগন্যান্ট (দূষিত) টিউমার:
- গ্লিওমাস: এটা মস্তিষ্কের গ্লিয়া কোষে গঠিত হয়। এর মধ্যে এস্ট্রোসাইটোমাস, ওলিগোডেনড্রোগ্লিওমাস এবং গ্লিওব্লাস্টোমাস অন্তর্ভুক্ত।
- মেডুলোব্লাস্টোমাস: শিশুদের মধ্যে সাধারণত পাওয়া যায় এবং মস্তিষ্কের নিম্নাংশে গঠিত হয়।
- ইপেন্ডাইমোমাস: মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ডের কেন্দ্রস্থল কোষে গঠিত হয়।
(খ) সেকেন্ডারি ব্রেন টিউমার
সেকেন্ডারি বা মেটাস্ট্যাটিক ব্রেন টিউমার শরীরের অন্য অংশ থেকে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সাধারণত ফুসফুস, স্তন, কিডনি, বা ত্বকের ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমাস থেকে ছড়ায়। এই ধরনের টিউমার সাধারণত ম্যালিগন্যান্ট হয়।
বয়সভেদে ব্রেন টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা
ব্রেন টিউমার যে কোনও বয়সেই হতে পারে। তবে, কিছু নির্দিষ্ট বয়সে এর ঝুঁকি বেশি দেখা যায়:
(ক) শিশু এবং কিশোর-কিশোরী: শিশুরা প্রায়ই প্রাইমারি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হতে পারে।
বাচ্চাদের ব্রেন টিউমারের লক্ষণ
আমরা সবাই জানি যে বাচ্চাদের সুস্থতা আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে কখনও কখনও কিছু রোগ অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত হানতে পারে। ব্রেন টিউমার এমন একটি রোগ যা বাচ্চাদের মধ্যেও হতে পারে। বাচ্চাদের ব্রেন টিউমারের লক্ষণ সম্পর্কে জানাবো।
১. নিয়মিত মাথাব্যথা
যদি আপনার বাচ্চা নিয়মিতভাবে মাথাব্যথায় কষ্ট পায়, বিশেষ করে সকালে উঠে, তাহলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হতে পারে।
২. বমি বা বমি বমি ভাব
সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি বাচ্চার বমি বমি ভাব বা বমি হয়, এটি ব্রেন টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।
৩. দৃষ্টিশক্তির সমস্যা
বাচ্চার যদি হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, চোখে ঝাপসা দেখার সমস্যা হয়, বা ডবল ভিশন হয়, তাহলে এটি ব্রেন টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।
৪. শরীরের দুর্বলতা
হাত বা পায়ে যদি দুর্বলতা, অসাড়তা বা অবশ অনুভব হয়, তাহলে এটি একটি গুরুতর সংকেত হতে পারে।
৫. সমন্বয়ের অভাব
বাচ্চার চলাচলে বা হাঁটতে সমস্যা হলে, বা হঠাৎ পড়ে গেলে, এটি ব্রেন টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।
৬. মেমোরি লস
যদি আপনার বাচ্চা হঠাৎ করে অনেক কিছু ভুলে যায় বা স্মৃতিশক্তি কমে যায়, তাহলে এটি একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে।
৭. মুড সুইং
বাচ্চার আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, অতিরিক্ত রাগ বা কষ্ট বা মানসিক অস্থিরতা লক্ষ্য করলে এটি ব্রেন টিউমারের একটি লক্ষণ হতে পারে।
৮. কথা বলার সমস্যা
যদি আপনার বাচ্চা কথা বলতে কষ্ট পায়, বাক্য গঠন করতে সমস্যা হয়, বা কথা বলার সময় অসুবিধা হয়, তাহলে এটি একটি সতর্ক সংকেত হতে পারে।
(খ) মধ্যবয়সী প্রাপ্তবয়স্ক: ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষের মধ্যে ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
(গ) বৃদ্ধ বয়স: ৬০ বছর বয়সের পর ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়, বিশেষ করে সেকেন্ডারি টিউমারের।
ব্রেন টিউমার প্রতিরোধের উপায়
যদিও ব্রেন টিউমার সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এর ঝুঁকি কমানো যেতে পারে:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: আপনার খাদ্য তালিকায় প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার রাখুন।
পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন পর্যাপ্ত এবং নিয়মিত ঘুম নিশ্চিত করুন।
ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: মেডিটেশন, যোগব্যায়াম এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
এলকোহল এবং তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করুন: এগুলি মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি করতে পারে এবং টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
রেডিয়েশন এড়ানো: অপ্রয়োজনীয় রেডিয়েশন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। বিশেষ করে মাথার রেডিয়েশন।
ব্রেন টিউমার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, তবে সঠিক সচেতনতা এবং জীবনে কিছু পরিবর্তন এনে আমরা এর ঝুঁকি কমাতে পারি। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারি। তাই আসুন, আজ থেকেই আমরা আমাদের জীবনধারায় এই পরিবর্তনগুলো আনতে শুরু করি।