বুটিজাম (Beetroot) একটি লাল রঙের শাকসবজি যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। এটি মূলত মাটির নিচে জন্মানো একটি শিকড় ফসল, যা সাধারণত খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বুটিজামের মিষ্টি স্বাদ এবং পুষ্টিকর উপাদানগুলো একে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বুটিজামের প্রকারভেদ
বুটিজাম বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- গোলাপি বুটিজাম: এই ধরনের বুটিজাম লাল রঙের হয় এবং সাধারণত বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। এটি স্যালাড ও রস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
- সোনালি বুটিজাম: এই বুটিজামের রঙ সোনালি বা হলুদ হয়। এটি সাধারণত মিষ্টি এবং কম মাটি স্বাদযুক্ত।
- শাদা বুটিজাম: এই প্রকারের বুটিজাম সাদা হয় এবং অন্যান্য প্রকারের তুলনায় কম মিষ্টি।
- ব্যান্ডেড বা ক্যান্ডি বুটিজাম: এই বুটিজামের ভেতরে লাল এবং সাদা রঙের চক্রাকারে ব্যান্ড থাকে, যা একে দেখতে খুবই আকর্ষণীয় করে তোলে।
নিয়মিত বুটিজাম খাওয়ার উপকারিতা
বুটিজাম নিয়মিত খাওয়ার অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এর পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতাগুলো নিম্নরূপ:
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: বুটিজামে থাকা নাইট্রেট রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তের প্রবাহ উন্নত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
- হজম শক্তি বৃদ্ধি: বুটিজামে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকে যা হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।
- রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ: বুটিজামে প্রচুর পরিমাণে আয়রন রয়েছে, যা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক। এটি রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
- লিভার পরিষ্কার রাখে: বুটিজাম লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি লিভারে টক্সিন অপসারণে সহায়ক।
- ওজন কমাতে সহায়ক: বুটিজাম কম ক্যালোরি যুক্ত কিন্তু বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন, যা ওজন কমাতে সহায়ক।
- ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি: বুটিজামে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং বার্ধক্যের ছাপ কমায়।
- মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে: বুটিজামে উপস্থিত বিটাইন এবং ট্রিপ্টোফ্যান মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মানসিক চাপ কমায়।
- প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: বুটিজামে ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
বুটিজাম এর পুষ্টিগুণ
বুটিজামে নিম্নলিখিত পুষ্টিগুণ রয়েছে:
- ক্যালোরি: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ৪৩ ক্যালোরি থাকে।
- ফাইবার: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ২.৮ গ্রাম ফাইবার থাকে।
- ভিটামিন সি: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ৪.৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে।
- ফোলেট: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ১০৯ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট থাকে।
- পটাশিয়াম: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ৩২৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে।
- ম্যাগনেসিয়াম: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ২৩ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম থাকে।
- আয়রন: প্রতি ১০০ গ্রাম বুটিজামে প্রায় ০.৮ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে।
বয়সভেদে বুটিজামের পরিমাণ
বুটিজাম (Beetroot) একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর শাকসবজি। এটি বিভিন্ন বয়সের মানুষের জন্য নানা উপকারে আসে, তবে প্রতিটি বয়সের মানুষের জন্য এর পরিমাণ আলাদা হতে পারে। আসুন জেনে নিই বয়সভেদে কতটুকু পরিমাণ বুটিজাম খাওয়া উচিত।
শিশুদের জন্য
বয়স: ৬ মাস থেকে ৫ বছর
শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য বুটিজাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, তাদের হজমশক্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল হওয়ায় পরিমাণে কম খাওয়ানো উচিত।
পরিমাণ:
- ৬ মাস থেকে ১ বছর: ২-৩ টেবিল চামচ বুটিজাম পিউরি
- ১ থেকে ৫ বছর: ১/৪ কাপ (প্রায় ৫০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
উপকারিতা:
- আয়রন ও ফোলেট সমৃদ্ধ বুটিজাম রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়ায়।
- ফাইবার শিশুদের হজমশক্তি উন্নত করে।
কিশোর-কিশোরীদের জন্য
বয়স: ৬ থেকে ১৮ বছর
এই বয়সের সময়ে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দ্রুত ঘটে, তাই পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজন বেশি।
পরিমাণ:
- ৬ থেকে ১২ বছর: ১/২ কাপ (প্রায় ১০০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
- ১৩ থেকে ১৮ বছর: ৩/৪ কাপ (প্রায় ১৫০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
উপকারিতা:
- বুটিজামে থাকা নাইট্রেট রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে শরীরের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
- ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
বয়স: ১৯ থেকে ৫০ বছর
প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরিক পরিশ্রম ও মানসিক চাপের কারণে পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে।
পরিমাণ:
- দিনে ১ কাপ (প্রায় ২০০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
উপকারিতা:
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
- হজমশক্তি উন্নত করে।
বয়স্কদের জন্য
বয়স: ৫১ বছর এবং তার উপরে
বয়স্কদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, তাই তাদের পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার খাওয়া জরুরি।
পরিমাণ:
- দিনে ৩/৪ কাপ (প্রায় ১৫০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
উপকারিতা:
- লিভার পরিষ্কার রাখতে সহায়ক।
- ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
গর্ভবতী নারীদের জন্য
গর্ভবতী নারীদের জন্য বুটিজাম অত্যন্ত পুষ্টিকর, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া উচিত।
পরিমাণ:
- দিনে ১/২ কাপ (প্রায় ১০০ গ্রাম) রান্না করা বুটিজাম
উপকারিতা:
- ফোলেট সমৃদ্ধ বুটিজাম গর্ভের শিশুর বিকাশে সহায়ক।
- আয়রন রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
বুটিজাম খাওয়ার সঠিক সময়
সকালে: সকালে খালি পেটে বুটিজাম খাওয়া যেতে পারে। এটি শরীরকে ডিটক্সিফাই করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বিকেলে: বিকেলের নাস্তা হিসেবে বুটিজামের স্যালাড খাওয়া যেতে পারে। এটি হালকা খাবার হিসেবে উপকারী।
বুটিজাম খাওয়ার সঠিক উপায়
- কাঁচা: বুটিজাম কাঁচা খাওয়া যেতে পারে। এটি স্যালাড হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। কাঁচা বুটিজাম স্লাইস করে লেবুর রস ও একটু লবণ দিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
- রান্না করা: বুটিজাম সেদ্ধ করে বা ভেজে খাওয়া যেতে পারে। সেদ্ধ বুটিজাম স্যুপ বা স্যালাডে যোগ করা যায়।
- রস করে: বুটিজাম রস করে খাওয়া যেতে পারে। বুটিজাম, গাজর ও আপেলের মিশ্রণে একটি স্বাস্থ্যকর জুস তৈরি করা যায়।
বুটিজাম খাওয়ার সঠিক উপাদানসমূহ
- লেবুর রস: বুটিজামের সাথে লেবুর রস মেশালে এর স্বাদ বাড়ে এবং ভিটামিন সি এর পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এটি আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
- লবণ ও গোলমরিচ: বুটিজামের সাথে লবণ ও গোলমরিচ যোগ করলে এর স্বাদ আরও উন্নত হয় এবং এটি সহজে হজম হয়।
- পুদিনা পাতা: বুটিজামের সাথে পুদিনা পাতা মিশিয়ে খেলে এটি আরো রিফ্রেশিং এবং সুস্বাদু হয়ে ওঠে।
- গাজর ও শসা: বুটিজাম, গাজর ও শসার মিশ্রণে একটি স্বাস্থ্যকর স্যালাড তৈরি করা যায়, যা পুষ্টিকর ও হালকা।
কখন ও কেন বুটিজাম খাওয়া উচিত না
- কিডনি সমস্যা: যাদের কিডনি সমস্যা আছে, তারা বুটিজাম কম খাওয়া উচিত। বুটিজামে অক্সালেটস থাকে, যা কিডনি স্টোনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত আয়রন: যাদের শরীরে অতিরিক্ত আয়রনের সমস্যা (হেমোক্রোমাটোসিস) রয়েছে, তাদের জন্য বুটিজাম খাওয়া উপযুক্ত নয়।
- অ্যালার্জি: যাদের বুটিজামের প্রতি অ্যালার্জি আছে, তারা এটি এড়িয়ে চলা উচিত। বুটিজাম খেলে অ্যালার্জির লক্ষণ যেমন চুলকানি, ফুসকুড়ি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।