নাট্টো হলো একটি জনপ্রিয় জাপানি খাবার যা ফারমেন্টেড সয়াবিন দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি খুবই পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে পরিচিত। নাট্টো সাধারণত নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়। এটা দেখতে কিছুটা চটচটে এবং স্বাদে কিছুটা তিক্ত।
নাট্টোর প্রকারভেদ
নাট্টোর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যা তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং ফারমেন্টেশনের সময়ের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন হতে পারে। প্রধান প্রকারভেদগুলো হলো:
১. ইতোহিকি নাট্টো (Itohiki Natto): এটি সবচেয়ে প্রচলিত নাট্টো। এটি ছোট ছোট সয়াবিন দিয়ে তৈরি হয় এবং ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে রাখা হয়। ইতোহিকি নাট্টো খুবই চটচটে এবং সুতোর মতো টেক্সচার তৈরি করে।
২. হিক্কিরি নাট্টো (Hikkiri Natto): এটি অপেক্ষাকৃত কম ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় এবং চটচটে কম থাকে। এটি কিছুটা শুকনো এবং তুলনামূলকভাবে কম তিক্ত।
৩. কিন্তোকিন নাট্টো (Kintokin Natto): এটি বড় সয়াবিন দিয়ে তৈরি হয় এবং কম চটচটে হয়। এটি স্বাদে কিছুটা মিষ্টি এবং কম তিক্ত।
নিয়মিত নাট্টো খাওয়ার উপকারিতা
১. প্রোবায়োটিকের উৎস
নাট্টো প্রোবায়োটিকের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং হজম প্রক্রিয়া সহজ করে। প্রোবায়োটিক অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
২. উচ্চ প্রোটিনের উৎস
নাট্টো উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম নাট্টোতে প্রায় ১৭-১৮ গ্রাম প্রোটিন থাকে, যা শরীরের পেশী গঠন এবং মেরামতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৩. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
নাট্টো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এতে থাকা এনজাইম নাট্টোকিনাস রক্তনালীর কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং রক্তপ্রবাহ উন্নত করে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
৪. হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করে
নাট্টোতে থাকা ভিটামিন কে২ হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি কমায়। এটি ক্যালসিয়াম শোষণ বাড়াতে সহায়ক।
৫. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
নাট্টো রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এতে থাকা ভিটামিন ই এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা উন্নত করে।
৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
নাট্টো ক্যালোরিতে কম এবং ফাইবার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ। এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভর্তি থাকে এবং ক্ষুধা কমায়, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
নাট্টো এর পুষ্টিগুণ
- ক্যালরি: ১০০ গ্রাম নাট্টোতে প্রায় ২০০ ক্যালরি থাকে।
- প্রোটিন: ১৭-১৮ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ১২-১৩ গ্রাম
- ফাইবার: ৫-৬ গ্রাম
- ফ্যাট: ১০-১১ গ্রাম
- ভিটামিন কে২: ৯০০-১০০০ মাইক্রোগ্রাম (প্রায় ১১২৫% ডেইলি ভ্যালু)
- ভিটামিন ই: ১.২ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ৩.৪ মিলিগ্রাম (প্রায় ১৯% ডেইলি ভ্যালু)
- ক্যালসিয়াম: ৯০ মিলিগ্রাম
- পটাসিয়াম: ৬৫০ মিলিগ্রাম
বয়সভেদে নাট্টো খাওয়ার পরিমাণ
নাট্টো একটি পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার যা সব বয়সের মানুষের জন্য উপকারী। তবে, বয়স অনুযায়ী নাট্টো খাওয়ার পরিমাণ ভিন্ন হতে পারে। নিচে বয়সভেদে নাট্টো খাওয়ার সঠিক পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
শিশু (১-১২ বছর)
শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য পুষ্টিকর খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নাট্টোতে থাকা প্রোবায়োটিক এবং প্রোটিন তাদের জন্য খুবই উপকারী। দিনে একবার নাস্তার সময় বা দুপুরের খাবারে প্রায় ২০-৩০ গ্রাম নাট্টো খাওয়ানো যেতে পারে। এটি তাদের পেটের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
কিশোর-কিশোরী (১৩-১৮ বছর)
এই বয়সে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দ্রুত ঘটে, ফলে বেশি পুষ্টির প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন ৩০-৫০ গ্রাম নাট্টো নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া তাদের জন্য উপকারী। এটি তাদের মেটাবলিজম উন্নত করবে এবং শক্তি যোগাবে।
যুবক-যুবতী (১৯-৩০ বছর)
এই বয়সে শরীরের চাহিদা বেশি থাকে এবং ব্যস্ত জীবনযাত্রায় অনেক শক্তি প্রয়োজন। প্রতিদিন ৫০-৭০ গ্রাম নাট্টো নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি তাদের শরীরে প্রাকৃতিক শক্তি যোগাবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
মধ্যবয়সী (৩১-৫০ বছর)
এই বয়সে শরীরের বিপাকীয় হার কিছুটা কমে যায় এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বেশি থাকে। প্রতিদিন ৫০-৭০ গ্রাম নাট্টো নাস্তা হিসেবে বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়া উচিত। এটি তাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে।
প্রবীণ (৫০ বছরের উপরে)
প্রবীণদের হজম প্রক্রিয়া ও শারীরিক কার্যক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। তাদের জন্য প্রতিদিন ৩০-৫০ গ্রাম নাট্টো নাস্তা হিসেবে বা স্যুপ, স্মুদি বা অন্যান্য খাবারের সাথে মিশিয়ে যথেষ্ট। এটি তাদের শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
কখন নাট্টো খাওয়া উচিত
সকালে নাস্তার সময়
সকালে নাস্তার সময় নাট্টো খাওয়া শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং সারাদিনের জন্য শরীরে প্রাকৃতিক শক্তি যোগায়। সকালে নাট্টো খেলে হজমশক্তি ভালো থাকে এবং পেট পরিষ্কার থাকে।
দুপুরের খাবারের সাথে
দুপুরের খাবারের সাথে নাট্টো খাওয়া একটি চমৎকার উপায়। এটি খাবারের স্বাদ বাড়ায় এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। দুপুরের খাবারের সাথে নাট্টো খেলে হজম প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং খাবারের পুষ্টিগুণ শোষণে সহায়ক হয়।
ব্যায়ামের পরে
ব্যায়ামের পরে নাট্টো খাওয়া শরীরের জন্য পুনরুজ্জীবিত হিসেবে কাজ করে। এতে প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে, যা পেশি পুনর্গঠনে সহায়ক।
কিভাবে নাট্টো খাওয়া উচিত
সরাসরি খাওয়া
নাট্টো সরাসরি খাওয়া যেতে পারে। এটি সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি। নাট্টো সাধারণত সামান্য মিশ্রিত করে সরাসরি খাওয়া হয়।
সালাদে মিশিয়ে
নাট্টো সালাদে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি বিভিন্ন সবজি এবং উপাদানের সাথে মিশিয়ে স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর সালাদ তৈরি করা যায়।
রান্নায় ব্যবহার
নাট্টো রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি স্যুপ, স্ট্যু বা অন্যান্য রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। রান্না করা নাট্টো খেলে এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ে।
কোন কোন উপাদানের সাথে নাট্টো খাওয়া উচিত
সবজি
নাট্টোর সাথে বিভিন্ন সবজি মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এটি সালাদ, স্ট্যু বা স্যুপের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। সবজি ও নাট্টো মিশিয়ে খেলে পুষ্টিগুণ বাড়ে এবং স্বাদে বৈচিত্র্য আনে।
চাল
নাট্টোর সাথে ভাত বা চাল খাওয়া যেতে পারে। এটি জাপানি খাবারের একটি প্রচলিত উপায়। ভাতের সাথে নাট্টো মিশিয়ে খেলে পুষ্টিগুণ বাড়ে এবং স্বাদে বৈচিত্র্য আনে।
ডিম
নাট্টোর সাথে ডিম খাওয়া খুবই পুষ্টিকর। এটি প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস এবং নাট্টোর সাথে মিশিয়ে খেলে স্বাদ বৃদ্ধি পায়। ডিম ও নাট্টো মিশিয়ে অমলেট বা স্ক্র্যাম্বল করা যেতে পারে।
কখন এবং কেন নাট্টো খাওয়া উচিত না
সয়া অ্যালার্জি থাকলে
যাদের সয়ার প্রতি অ্যালার্জি আছে তাদের জন্য নাট্টো খাওয়া উচিত নয়। এটি ত্বকের প্রদাহ, চুলকানি বা অন্যান্য অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
রক্তপাতজনিত সমস্যা থাকলে
নাট্টোতে থাকা ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই যাদের রক্তপাতজনিত সমস্যা আছে বা যারা অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধ গ্রহণ করছেন তাদের নাট্টো খাওয়া উচিত নয়।
থাইরয়েড সমস্যা থাকলে
যাদের থাইরয়েড সমস্যা আছে তাদের জন্য অতিরিক্ত নাট্টো খাওয়া উচিত নয়। এতে উচ্চ পরিমাণে আয়োডিন থাকে যা থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে।