ত্বকের ক্যান্সার হচ্ছে এমন এক ধরনের ক্যান্সার যা ত্বকের কোষে শুরু হয়। এটি সাধারণত ত্বকের ওপরের স্তরে দেখা যায়, যেখানে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি সরাসরি প্রভাব ফেলে। ত্বকের ক্যান্সার বেশিরভাগ সময় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং সহজে নিরাময়যোগ্য হয় যদি প্রথম পর্যায়েই এটি শনাক্ত করা যায়।
ত্বকের ক্যান্সারের প্রকারভেদ
ত্বকের ক্যান্সার প্রধানত তিনটি প্রধান প্রকারে বিভক্ত:
- বেসাল সেল কার্সিনোমা (Basal Cell Carcinoma): এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং কম বিপজ্জনক ধরনের ত্বকের ক্যান্সার। এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণত দেহের এমন স্থানে দেখা যায় যেখানে সূর্যের প্রভাব বেশি পড়ে, যেমন মুখ, কান, ও ঘাড়।
- স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma): এটি ত্বকের দ্বিতীয় স্তর থেকে উৎপন্ন হয় এবং কিছুটা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি শরীরের যে কোন স্থানে দেখা যেতে পারে, তবে সাধারণত সূর্যপ্রভাবিত স্থানে বেশি দেখা যায়।
- মেলানোমা (Melanoma): এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক ত্বকের ক্যান্সার। মেলানোসাইট নামে ত্বকের কোষ থেকে উৎপন্ন হয় যা ত্বককে রঙিন করে তোলে। এটি দ্রুত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এর ফলে মারাত্মক হতে পারে।
কী কারণে ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে?
ত্বকের ক্যান্সার বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সাধারণত ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV Radiation): সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের কোষের ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা ত্বকের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলোতে থাকার ফলে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
আলো থেকে প্রাপ্ত কৃত্রিম UV রশ্মি: সানল্যাম্প বা সানবেডের মতো কৃত্রিম আলো থেকেও অতিবেগুনি রশ্মি পাওয়া যায়, যা ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
হালকা ত্বক: হালকা ত্বকের লোকেদের ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ তাদের ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ কম থাকে, যা ত্বককে UV রশ্মির ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ইতিহাস: যদি পরিবারে ত্বকের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তবে ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, পূর্বে ত্বকের ক্যান্সার হয়ে থাকলে পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের ক্ষতি বা জ্বালা: দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত বা জ্বালাযুক্ত ত্বকে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন, বারবার ত্বকের কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আঘাত লাগা বা জ্বালা হওয়া।
কিছু রাসায়নিকের প্রভাব: আর্সেনিক, টার, বা কিছু শিল্প রাসায়নিকের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের সংস্পর্শে থাকাও ত্বকের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কি কি?
ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো খুব সহযে দেখা যেতে পারে, তবে কখনো কখনো সেগুলো ছোট এবং অবহেলাযোগ্য হতে পারে। ত্বকের ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
- অস্বাভাবিক ত্বকের বৃদ্ধি: কোন অস্বাভাবিক তিল, ফোড়া, ঘা বা দাগ দেখা দিলে এবং সেটি সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেলে তা ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
- নতুন তিলের সৃষ্টি: ত্বকে নতুন তিলের সৃষ্টি হলে এবং সেটি আকার, রঙ বা আকারে বদলালে সতর্ক হতে হবে।
- তিল বা দাগের রঙ পরিবর্তন: তিল বা দাগের রঙ যদি কালো, লাল, নীল বা সাদা হয়ে যায় তবে এটি ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
- আকার ও আকৃতির পরিবর্তন: তিল বা দাগের আকার যদি বাড়তে থাকে এবং তার আকৃতি বৃদ্ধি হয়ে যায় তবে এটি ক্যান্সারের ইঙ্গিত হতে পারে।
- আঁচিলে রক্তপাত বা ঘা হওয়া: তিল বা দাগ থেকে যদি রক্তপাত হয় বা ঘা হয় এবং সেটি সারতে সময় লাগে তবে সতর্ক হতে হবে।
- খুব চুলকানি বা ব্যথা: তিল বা দাগের স্থানে খুব চুলকানি বা ব্যথা হলে সেটি ত্বকের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
বয়সভেদে ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা
শিশু এবং কিশোর-কিশোরী: ত্বকের ক্যান্সার সাধারণত ছোট বাচ্চা এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কম দেখা যায়। তবে, শিশুদের ত্বকে যদি সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি পড়ে থাকে, তবে তারা বড় হলে এর ঝুঁকি বাড়তে পারে।
২০-৩০ বছর বয়স: এই বয়সের লোকেদের মধ্যে মেলানোমা ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি থাকে। তরুণ বয়সে অতিরিক্ত সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মির সংস্পর্শে আসলে বা সানবাথ ব্যবহার করা হলে এই ঝুঁকি বাড়ে।
৩০-৫০ বছর বয়স: এই বয়সে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে শুরু করে। কাজের চাপ এবং জীবনযাত্রার ধরণও এই ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
৫০ বছর এবং তদূর্ধ্ব: ৫০ বছর বয়সের পর ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। বয়সের সাথে সাথে ত্বকের কোষের পুনর্গঠন ক্ষমতা কমে আসে, ফলে ত্বকের ক্ষতি সহজেই ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।
৬৫ বছর এবং তদূর্ধ্ব: এই বয়সে ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি সর্বাধিক থাকে। দীর্ঘক্ষণ সূর্যের সংস্পর্শ, ত্বকের বার্ধক্য, এবং কম ইমিউন প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে এই বয়সে ত্বকের ক্যান্সার বেশি দেখা যায়।
ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় গুলো কি কি?
ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় তুলে ধরা হলো:
১. সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা
সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন: প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার আগে অবশ্যই SPF 30 বা তার বেশি মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। এটি আপনার ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর UV রশ্মি থেকে রক্ষা করবে।
পর্যাপ্ত পোশাক পরুন: বাইরে যাওয়ার সময় দীর্ঘ হাতা জামা, প্যান্ট এবং হ্যাট পরুন যা সূর্য থেকে ত্বককে ঢেকে রাখবে।
ছাতা ব্যবহার করুন: রোদে বের হলে ছাতা ব্যবহার করুন। এটি সরাসরি সূর্যরশ্মি থেকে রক্ষা করবে।
২. কৃত্রিম UV রশ্মি এড়িয়ে চলুন: ট্যানিং বেড ব্যবহার করবেন না। এগুলো ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৩. নিয়মিত ত্বকের পরীক্ষা করুন
নিজে ত্বকের পরীক্ষা করুন: নিয়মিত নিজের ত্বক পরীক্ষা করুন। নতুন তিল বা দাগ দেখা দিলে, অথবা পুরানো তিলের আকার, রঙ বা গঠনে পরিবর্তন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বার্ষিক ডার্মাটোলজিস্ট চেকআপ: বছরে অন্তত একবার ডার্মাটোলজিস্টের কাছে যান এবং সম্পূর্ণ ত্বকের পরীক্ষা করান।
৪. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন
পুষ্টিকর খাবার খান: ফল, সবজি, বাদাম, এবং শস্যজাতীয় খাবার বেশি করে খান। এই খাবারগুলোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত পানি পান করুন: ত্বক হাইড্রেটেড রাখতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন।
৫. ধূমপান এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
ধূমপান বন্ধ করুন: ধূমপান ত্বকের কোষের ক্ষতি করে এবং ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান এড়িয়ে চলুন।
অ্যালকোহল সীমিত করুন: অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা ত্বকের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তাই অ্যালকোহলের ব্যবহার সীমিত করুন।
৬. নিয়মিত ব্যায়াম করুন: নিয়মিত ব্যায়াম ত্বকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে এবং ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, যা ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
৭. পরিবেশগত দূষণ: বায়ু দূষণ ত্বকের ক্ষতি করতে পারে, তাই দূষণপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। বাইরে গেলে মুখ ঢেকে রাখুন এবং বাড়ি ফিরে ত্বক ভালো করে পরিষ্কার করুন।
৮. স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: অতিরিক্ত মানসিক চাপ ত্বকের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন বা শখের কাজগুলো করে মানসিক চাপ কমান।
ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধের এই উপায়গুলো মেনে চললে ত্বককে ক্যান্সারের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। আপনার ত্বকের যত্ন নিন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।