গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার কি?

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার, যাকে পেটের ক্যান্সারও বলা হয়, এটি পেটের ভিতরের লাইনিং বা স্তরের কোষগুলোর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিস্তারের ফলে সৃষ্টি হয়। এটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং প্রথমে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না, যার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে এটি সনাক্ত করা কঠিন হয়। গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে যেসব দেশে খাদ্যাভ্যাস এবং জীবাণু সংক্রমণের কারণে ঝুঁকি বেশি।

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার এর লক্ষণ গুলো কি কি?

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের লক্ষণগুলি প্রাথমিক অবস্থায় খুবই কম হতে পারে, যা অন্য সাধারণ গ্যাস্ট্রিক সমস্যার মতো অনুভূত হয়। তবে, কিছু সাধারণ লক্ষণ এবং উপসর্গ রয়েছে যা সময়ের সাথে আরও প্রকট হতে পারে। নিচে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের কিছু প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করা হল:

অস্বাভাবিক পেটের ব্যথা:

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের প্রধান লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হলো পেটে অস্বাভাবিক ব্যথা। এটি সাধারণত খাবার পর বেশি অনুভূত হয় এবং সময়ের সাথে সাথে এটি তীব্র হতে পারে।

খাদ্যে অরুচি ও ওজন হ্রাস:

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার রোগীরা প্রায়ই খাবারে অরুচি অনুভব করেন এবং তাদের ওজন কমতে শুরু করে। খাবার খাওয়ার ইচ্ছা কমে গেলে শরীরের ওজন দ্রুত কমতে শুরু করে।

বমি বমি ভাব ও বমি:

পেটে অস্বস্তির কারণে অনেক সময় বমি বমি ভাব হতে পারে এবং মাঝে মাঝে বমিও হতে পারে। বমির সাথে রক্ত আসাও একটি গুরুতর লক্ষণ।

পেট ফুলে যাওয়া:

হজমের সমস্যা এবং পেট ফুলে যাওয়া গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের আরেকটি লক্ষণ হতে পারে। খাবার গ্রহণের পর পেট ফুলে যেতে পারে এবং হজমে সমস্যা হতে পারে।

কোনো কারণ ছাড়াই ক্লান্তি:

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার রোগীরা অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব করেন। শরীরের রক্তস্বল্পতা এবং পুষ্টিহীনতার কারণে এই সমস্যা দেখা দেয়।

কোনো কিছু গিলতে অসুবিধা:

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের কারণে কোনো কিছু গিলতে অসুবিধা হতে পারে। এটি খাবার গ্রহণের সময় ব্যথা এবং অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।

কী কারণে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হতে পারে?

বিভিন্ন কারনে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। নিচে এই কারণগুলি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল:

১. হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori) একটি ব্যাকটেরিয়া যা পেটের অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রিক প্রদাহ (গ্যাস্ট্রাইটিস) এবং আলসার সৃষ্টি করতে পারে। এই সংক্রমণটি দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে, গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

২. দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রাইটিস

দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রাইটিস, যা পেটের অন্ত্রের প্রদাহ, গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের আরেকটি প্রধান কারণ হতে পারে। এটি সাধারণত হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ বা দীর্ঘদিন ধরে NSAID (নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ) গ্রহণের ফলে হতে পারে।

৩. খাদ্যাভ্যাস

অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। বিশেষ করে অতিরিক্ত লবণাক্ত, ধূমায়িত, এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন আচার, ক্যানড ফুড, এবং শুকনো মাছ খাওয়া গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. ধূমপান এবং অ্যালকোহল

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এই অভ্যাসগুলি পেটের অন্ত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও বিস্তারে সহায়তা করে।

৫. পারিবারিক ইতিহাস

যদি পূর্বে পরিবারের কোনো সদস্য গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, তাহলে সেই পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এই ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। জিনগত কারণেও গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হতে পারে।

৬. বয়স এবং লিঙ্গ

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। পুরুষদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি মহিলাদের তুলনায় বেশি।

বয়সভেদে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা 

বয়সভেদে এই রোগের ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

২০-৩০ বছর

এই বয়সে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে, যদি কোনো জিনগত ঝুঁকি বা দীর্ঘস্থায়ী হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ থাকে, তাহলে এই বয়সেও গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার হতে পারে।

৩০-৫০ বছর

এই বয়সে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে। দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রাইটিস, অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, এবং ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ এই বয়সে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৫০ বছরের উপরে

৫০ বছরের উপরে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক হারে বৃদ্ধি পায়। এই বয়সে হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ, দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রাইটিস, এবং অন্য স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

৬০ বছরের উপরে

৬০ বছরের উপরে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় গুলো কি কি?

১. সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ

সঠিক খাদ্যাভ্যাস গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

  • শাকসবজি ও ফলমূল: প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। এগুলোতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে।
  • ফাইবারযুক্ত খাবার: যেমন, পুরো শস্য, ব্রাউন রাইস, ওটস ইত্যাদি হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখে এবং গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
  • প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: মাছ, মুরগি, বাদাম, ও বীজ প্রোটিনের ভালো উৎস। এদের মাধ্যমে শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

২. প্রক্রিয়াজাত ও লবণাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা

প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন, ধূমায়িত মাংস, ক্যানড ফুড, এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

  • কম লবণ ব্যবহার: খাবারে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার না করে, প্রাকৃতিক মশলা এবং লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন।
  • প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা: প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার বেছে নিন। ক্যানড এবং প্যাকেটজাত খাবার কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।

৩. ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার

ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানের অভ্যাস গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই, এই অভ্যাসগুলো ত্যাগ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

  • ধূমপান ছাড়া: ধূমপান শরীরের প্রতিটি অঙ্গের জন্য ক্ষতিকর। এটি ত্যাগ করলে গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার সহ অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে।
  • অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকুন। পরিমিত অ্যালকোহল পান করতে পারেন, তবে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে।

৪. হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ পরীক্ষা ও চিকিৎসা

হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (H. pylori) একটি ব্যাকটেরিয়া যা পেটের লাইনিংয়ে সংক্রমণ ঘটাতে পারে এবং গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: যদি গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে বা উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা করানো উচিত।
  • সংক্রমণ নির্ণয় ও চিকিৎসা: হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি সংক্রমণ নির্ণয় ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রুত গ্রহণ করা উচিত।

৫. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

সুস্থ জীবনযাপন গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

  • নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন। এটি শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • মানসিক চাপ কমানো: মানসিক চাপ কমানোর জন্য যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা অন্যান্য রিল্যাক্সেশন টেকনিক ব্যবহার করুন।

৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

  • সুষম খাদ্য গ্রহণ: ফাইবার এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান যা দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। ঘুমের অভাব হরমোনের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করতে পারে, যা ওজন বৃদ্ধি করতে পারে।

৭. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

যদি পরিবারের কারো গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার থাকে বা আপনি ঝুঁকিতে থাকেন, তাহলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত।

নিয়মিত চেকআপ: প্রতিবছর শরীরের নিয়মিত চেকআপ গুলো করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

অ্যাডভান্সড টেস্ট: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের সম্ভাবনা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান।

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও, প্রাথমিক অবস্থায় সনাক্ত হলে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। সুতরাং, শরীরে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024