গর্ভাবস্থা একজন মহিলার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে, শরীরে অনেক পরিবর্তন ঘটে যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূত্রনালীর সংক্রমণ (Urinary Tract Infection – UTI)।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ কি?
মূত্রনালীর সংক্রমণ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থায় এই সংক্রমণ সাধারণত বেশি দেখা যায় কারণ এই সময়ে শরীরে বিভিন্ন হরমোনাল এবং শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। মূত্রনালীর সংক্রমণ সাধারণত মূত্রাশয়ে (সিস্টাইটিস) শুরু হয়, তবে এটি কিডনিতে (পাইলোনেফ্রাইটিস) ছড়াতে পারে এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ এর কারণ গুলো কি কি?
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের কিছু প্রধান কারণ নিম্নরূপ:
১. হরমোনাল পরিবর্তন
গর্ভাবস্থায় হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে মূত্রনালীর পেশি শিথিল হয়, যা মূত্রের প্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। প্রোজেস্টেরন হরমোনের বৃদ্ধি মূত্রনালীর পেশির শিথিলতা বাড়িয়ে দেয়, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২. ইউটেরাসের বৃদ্ধি
গর্ভাবস্থায় ইউটেরাস (গর্ভাশয়) বৃদ্ধি পায় এবং এটি মূত্রনালীর উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে মূত্রনালীর সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং মূত্রের প্রবাহ কমে যায়, যা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে।
৩. মূত্রথলিতে পূর্ণ মূত্র না যাওয়া
গর্ভাবস্থায় অনেক সময় মহিলারা পুরোপুরি মূত্রত্যাগ করতে পারেন না। মূত্রথলিতে মূত্র জমে থাকলে ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ে এবং সংক্রমণ হতে পারে।
৪. ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ইমিউন সিস্টেম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে শরীর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কম কার্যকরীভাবে লড়াই করতে পারে, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৫. পূর্ববর্তী সংক্রমণের ইতিহাস
যেসব মহিলাদের পূর্বে মূত্রনালীর সংক্রমণ হয়েছে, তাদের গর্ভাবস্থায় আবার সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। পূর্ববর্তী সংক্রমণের কারণে মূত্রনালী দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৬. অপর্যাপ্ত হাইজিন
পর্যাপ্ত হাইজিন না মানলে মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর পরিষ্কার না করলে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ করতে পারে এবং সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের লক্ষণ গুলো কি কি?
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে, যা সাধারণত দ্রুত চিহ্নিত করা যায়। এর মধ্যে কিছু প্রধান লক্ষণ নিম্নরূপ:
১. প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া অনুভব করা। এটি সংক্রমণের কারণে মূত্রনালীর প্রাচীরে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
২. ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণে মহিলারা ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন। এমনকি মূত্রথলি পূর্ণ না থাকলেও প্রস্রাবের জন্য বারবার টয়লেট যাওয়ার ইচ্ছা হয়।
৩. প্রস্রাবের রং এবং গন্ধের পরিবর্তন
মূত্রনালীর সংক্রমণের ফলে প্রস্রাবের রং ঘন হলুদ বা বাদামী হয়ে যেতে পারে এবং এর গন্ধ পরিবর্তিত হয়ে তীব্র হয়ে যেতে পারে।
৪. প্রস্রাবে রক্ত
কিছু ক্ষেত্রে মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে প্রস্রাবে রক্ত দেখা যেতে পারে। এটি সাধারণত সংক্রমণের গুরুতর পর্যায়ে ঘটে।
৫. তলপেটে বা পিঠের নিচে ব্যথা
মূত্রনালীর সংক্রমণের ফলে তলপেটে বা পিঠের নিচে ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত তীব্র এবং স্থায়ী হয়।
৬. জ্বর এবং শীত
মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে জ্বর এবং শীত লাগার অনুভূতি হতে পারে। এটি সাধারণত সংক্রমণ কিডনিতে ছড়িয়ে পড়লে ঘটে।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের জটিলতা গুলো কি কি?
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি কিছু গুরুতর জটিলতার কারণ হতে পারে। এর মধ্যে কিছু প্রধান জটিলতা হলো:
১. প্রি-টার্ম লেবার
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে প্রি-টার্ম লেবারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। সংক্রমণের কারণে গর্ভাশয়ের প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা প্রি-টার্ম লেবারের কারণ হতে পারে।
২. পাইলোনেফ্রাইটিস
মূত্রনালীর সংক্রমণ যদি কিডনিতে ছড়িয়ে পড়ে, তবে এটি পাইলোনেফ্রাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। এটি কিডনির সংক্রমণ যা অত্যন্ত গুরুতর এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
৩. জন্মের সময় কম ওজন
মূত্রনালীর সংক্রমণের কারণে শিশুর জন্মের সময় কম ওজন হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এটি সাধারণত প্রি-টার্ম লেবারের কারণে ঘটে।
৪. মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হয়, তবে মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। গুরুতর সংক্রমণের ফলে সেপসিস হতে পারে, যা প্রাণঘাতী হতে পারে।
কোন বয়সে গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
কিশোরী ও যুবতী (১৮-২৫ বছর)
কিশোরী ও যুবতী মহিলাদের মধ্যে গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে, এই বয়সে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে সংক্রমণের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
- হরমোনাল পরিবর্তন: এই বয়সে হরমোনাল পরিবর্তন বেশি থাকে, যা মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- স্বল্প অভিজ্ঞতা: গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা কিশোরী ও যুবতী মহিলারা প্রায়ই সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন না থাকেন।
প্রাপ্তবয়স্ক (২৫-৩৫ বছর)
প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ সময় মহিলাদের জীবনে বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটে যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- ইমিউন সিস্টেমের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থায় ইমিউন সিস্টেম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
- মূত্রনালীতে চাপ: গর্ভাবস্থার সময় ইউটেরাসের বৃদ্ধি মূত্রনালীতে চাপ সৃষ্টি করে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
মধ্যবয়সী (৩৫-৪৫ বছর)
মধ্যবয়সী মহিলাদের মধ্যে গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এ সময় শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন এবং রোগের কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- শারীরিক পরিবর্তন: বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
- পূর্ববর্তী সংক্রমণ: যদি পূর্বে মূত্রনালীর সংক্রমণ হয়ে থাকে, তবে গর্ভাবস্থায় সেই সংক্রমণ আবারও হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায়
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
১. পর্যাপ্ত পানি পান
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা গুরুত্বপূর্ণ। পানি শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে এবং মূত্রনালীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
২. হাইজিন বজায় রাখা
পর্যাপ্ত হাইজিন মানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টয়লেট ব্যবহারের পর সঠিকভাবে পরিষ্কার করুন এবং সবসময় সামনে থেকে পিছনে পরিষ্কার করুন যাতে ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালীতে প্রবেশ না করতে পারে।
৩. প্রস্রাব ধরা থেকে বিরত থাকা
প্রস্রাব ধরা থেকে বিরত থাকুন। মূত্রথলি পূর্ণ হয়ে গেলে তা খালি করতে দেরি করবেন না। প্রস্রাব ধরে রাখলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৪. ক্র্যানবেরি জুস পান করা
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্র্যানবেরি জুস মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। তবে, এটি ব্যবহার করার আগে ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৫. পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস
সঠিক এবং পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করুন। তাজা ফল, সবজি, পূর্ণ শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন, যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৬. আরামদায়ক পোশাক পরিধান
আরামদায়ক এবং ঢিলা পোশাক পরিধান করুন। টাইট পোশাক পরিধানের ফলে মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। বিশেষ করে সুতি কাপড়ের অন্তর্বাস ব্যবহার করুন যা ত্বকের শ্বাস-প্রশ্বাসের সুযোগ দেয়।
৭. প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ
যদি কোনো সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন। প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্রমণ চিহ্নিত করে চিকিৎসা করা হলে জটিলতা কমানো সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমণ একটি সাধারণ সমস্যা হলেও, সঠিক পুষ্টি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করলে এর প্রতিরোধ সম্ভব। মূত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি এবং প্রতিরোধের উপায়গুলি সম্পর্কে সচেতন থাকলে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা বজায় রাখা সম্ভব।