খাদ্যনালী ক্যান্সার হল এমন এক ধরনের ক্যান্সার যা খাদ্যনালীতে (গলা থেকে পাকস্থলীতে খাবার পৌঁছানোর নালি) বৃদ্ধি পায়। এটি সাধারণত খাদ্যনালীর অন্তঃত্বকে (এপিথেলিয়াম) শুরু হয় এবং পরে গভীর টিস্যু ও অঙ্গগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যনালী ক্যান্সার প্রধানত দুই প্রকারের হতে পারে:

  • স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা (Squamous Cell Carcinoma): এটি খাদ্যনালীর উপরের এবং মধ্যভাগে দেখা যায়।
  • এডেনোকার্সিনোমা (Adenocarcinoma): এটি খাদ্যনালীর নীচের অংশে এবং পাকস্থলীর সংযোগস্থলে বেশি দেখা যায়।

কী কারণে খাদ্যনালী ক্যান্সার হতে পারে?

খাদ্যনালী ক্যান্সারের প্রধান কারণগুলো অনেকটা জীবনধারা এবং খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে কিছু প্রধান কারণ উল্লেখ করা হলো:

১. তামাক ও অ্যালকোহল সেবন:

তামাক এবং অ্যালকোহল সেবন খাদ্যনালী ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। তামাকের ধোঁয়া এবং অ্যালকোহলের রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যনালীর কোষে ক্ষতি করতে পারে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

২. গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD):

দীর্ঘমেয়াদী GERD এর কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীতে ফিরে আসতে পারে, যা খাদ্যনালীর ক্ষতি করতে পারে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. মোটা বা স্থূলতা:

মোটা বা স্থূলতা খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। অধিক ওজনের কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৪. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:

ফল ও শাকসবজি কম খাওয়া, উচ্চমাত্রার প্রসেসড খাবার ও ফাস্ট ফুড খাওয়া খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

৫. বংশগত কারণ:

বংশগত কারণও খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যদি পরিবারের কারও খাদ্যনালী ক্যান্সার থাকে, তবে আপনার ঝুঁকি বাড়তে পারে।

খাদ্যনালী ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কি কি?

খাদ্যনালী ক্যান্সারের লক্ষণগুলো প্রাথমিক অবস্থায় খুব বেশি স্পষ্ট হয় না, কিন্তু যখন এটি বৃদ্ধি পায়, তখন কিছু বেশ কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। এই লক্ষণগুলোতে রয়েছে:

১. গিলতে অসুবিধা (ডিসফাজিয়া):

গিলতে সমস্যা হলে বা গলায় খাবার আটকে যাওয়ার অনুভূতি হলে এটি খাদ্যনালী ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। প্রথমে কঠিন খাবার গিলতে সমস্যা হয়, পরে তরল খাবার গিলতেও সমস্যা হতে পারে।

২. বুক জ্বালা (হার্টবার্ন) এবং বুকের ব্যথা:

হার্টবার্ন বা বুক জ্বালা অনেক সময় গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) এর লক্ষণ হতে পারে, তবে এটি খাদ্যনালী ক্যান্সারেরও একটি লক্ষণ হতে পারে। বুকের মাঝখানে বা গলার দিকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

৩. ওজন হ্রাস:

হঠাৎ শরীরের ওজন হ্রাস খাদ্যনালী ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে। এটি সাধারণত খাবার গিলতে সমস্যার কারণে ঘটে।

৪. বমি ও খাবার ফেরত আসা:

খাবার গিলতে সমস্যা হলে বমি হতে পারে বা খাবার খাওয়া পর গলা দিয়ে উপরে ফেরত আসতে পারে।

৫. কাশি ও গলার স্বর পরিবর্তন:

নিয়মিত কাশি বা গলার স্বর পরিবর্তন হলে তা খাদ্যনালী ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

৬. ক্লান্তি ও দুর্বলতা:

অবিরাম ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব হলে তা ক্যান্সারের একটি সাধারণ লক্ষণ হতে পারে।

বয়সভেদে খাদ্যনালী ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা

খাদ্যনালী ক্যান্সার সাধারণত বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তবে বিভিন্ন বয়সে এর ঝুঁকি ভিন্ন হতে পারে।

৩০ বছরের নিচে:

এ বয়সে খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি সাধারণত কম থাকে। তবে, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন, মোটা বা স্থূলতা এবং GERD এর কারণে এই ঝুঁকি বাড়তে পারে।

৩০-৫০ বছর:

এই বয়সের মধ্যে খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে। যারা দীর্ঘমেয়াদী GERD, বারেট’স ইসোফ্যাগাস, বা তামাক ও অ্যালকোহল সেবন করেন, তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি থাকে।

৫০ বছরের উপরে:

৫০ বছরের উপরে খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এই বয়সে কোষের পরিবর্তন এবং কোষ এর  পুনগঠন ক্ষমতা কমে যায়, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

৬০ বছরের উপরে:

৬০ বছরের উপরে খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি সর্বাধিক হয়। এই বয়সে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা এবং জীবনধারার কারণে কোষের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

খাদ্যনালী ক্যান্সার ঝুঁকি কমানোর উপায়

খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এবং এর প্রতিরোধে কিছু কার্যকর উপায় আছে।

১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল, সবজি, এবং শস্য জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ভিটামিন, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা খাদ্যনালীর কোষের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।

২. তামাক ও অ্যালকোহল এড়ানো:

তামাক এবং অ্যালকোহল সেবন খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই তামাক ও অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকা উচিত। ধূমপান বন্ধ করলে এবং অ্যালকোহল সেবন নিয়ন্ত্রণ করলে খাদ্যনালীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ:

মোটা বা স্থূলতা খাদ্যনালী ক্যান্সারের একটি বড় ঝুঁকি। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাদ্যের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে তা শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকতে সহায়তা করে।

৪. গ্যাস্ট্রোইসোফ্যাজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD) এর নিয়ন্ত্রণ:

GERD খাদ্যনালী ক্যান্সারের একটি বড় কারণ। তাই GERD নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক ওষুধ গ্রহণ এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত ও অম্লীয় খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।

৫. স্বাস্থ্যকর পানীয়:

কার্বনেটেড ড্রিংকস এবং অতিরিক্ত চিনি মিশ্রিত পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত। এর পরিবর্তে প্রচুর পানি পান করা উচিত, যা দেহের টক্সিন বের করে এবং খাদ্যনালীর স্বাস্থ্য রক্ষা করে।

খাদ্যনালী ক্যান্সার প্রতিরোধ এর উপায়

খাদ্যনালী ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

১. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:

প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যনালী ক্যান্সার শনাক্ত করতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি। বিশেষ করে যদি আপনি GERD বা বারেট’স ইসোফ্যাগাসে ভুগে থাকেন, তাহলে নিয়মিত এন্ডোস্কোপি করানো উচিত।

২. পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল গ্রহণ:

খাদ্যনালীর স্বাস্থ্য রক্ষায় ভিটামিন ও মিনারেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই এর পর্যাপ্ত গ্রহণ খাদ্যনালীর কোষকে সুস্থ রাখে।

৩. ব্যায়াম:

নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। হাঁটা, দৌড়ানো, সাঁতার কাটা বা যোগব্যায়াম করলে তা শরীরের জন্য খুবই উপকারী।

৪. চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খাওয়া:

অতিরিক্ত চিনি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার খাদ্যনালীর ক্ষতি করতে পারে। তাই এসব খাবার কম খাওয়া উচিত এবং স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার প্রতি জোর দেওয়া উচিত।

৫. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ:

মানসিক চাপ খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত।

খাদ্যনালী ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে খাদ্যনালী ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়। যেকোনও অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক জীবনধারা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা সুস্থ থাকতে পারি।

Categorized in:

Dietary and Nutrition,

Last Update: December 23, 2024