কিডনি ক্যান্সার কিডনির কোষ থেকে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে কিডনি টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে। কিডনি দুটি মটর আকৃতির অঙ্গ যা আমাদের শরীরে রক্ত পরিষ্কার করে এবং অতিরিক্ত জল ও বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিডনি ক্যান্সার মূলত মধ্যবয়স্ক বা বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে যে কোনো বয়সে এটি হতে পারে।
কিডনি ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কি কি?
কিডনি ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো খুবই সূক্ষ্ম এবং অনেক সময় বোঝা যায় না। কিন্তু যখন ক্যান্সার কিছুটা বেড়ে যায়, তখন কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। নিচে কিডনি ক্যান্সারের কিছু সাধারণ লক্ষণ উল্লেখ করা হলো:
প্রস্রাবে রক্ত: কিডনি ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো প্রস্রাবে রক্ত দেখা দেওয়া। এটি অনেক সময় খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রস্রাবের পরীক্ষায় ধরা পড়ে।
পিঠ বা পাশে ব্যথা: অনেক সময় কিডনি ক্যান্সারের কারণে পিঠের নিচের দিকে বা পাশের দিকে স্থায়ী ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত তীব্র বা হালকা হতে পারে এবং অনেক দিন স্থায়ী হয়।
ওজন কমে যাওয়া: যদি বিনা কারণেই আপনার ওজন দ্রুত কমতে থাকে, তবে এটি কিডনি ক্যান্সারের একটি সতর্কবার্তা হতে পারে।
বুক ধড়ফড় করা: অনেক সময় কিডনি ক্যান্সারের কারণে অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে, যা বুক ধড়ফড় করার কারণ হতে পারে।
শরীরের একপাশ ফুলে যাওয়া: কিডনি ক্যান্সারের কারণে অনেক সময় শরীরের একপাশে বা কিডনির আশেপাশের স্থানগুলো ফোলা দেখা যায়।
উচ্চ রক্তচাপ: কিডনি ক্যান্সার উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। এটি একটি অস্বাভাবিক লক্ষণ হলেও, কিডনি সমস্যা থাকলে রক্তচাপ বাড়তে পারে।
জয়েন্টে ব্যথা ও ফুলে যাওয়া: কিছু ক্ষেত্রে কিডনি ক্যান্সারের ফলে শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা ও ফোলাভাব দেখা যায়।
কী কারণে কিডনি ক্যান্সার হতে পারে?
কিডনি ক্যান্সার হওয়ার কিছু সাধারণ কারণ নিচে আলোচনা করা হলো:
ধূমপান: ধূমপান কিডনি ক্যান্সার হওয়ার অন্যতম মূল কারণ। ধূমপানের ফলে শরীরে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ জমা হয় যা কিডনির ক্ষতি করে।
স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্থূলতা শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটায় যা কিডনির কোষকে প্রভাবিত করে।
উচ্চ রক্তচাপ: দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ রক্তচাপ থাকার ফলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে এবং কিডনির টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
পারিবারিক ইতিহাস: পরিবারের মধ্যে কারো কিডনি ক্যান্সার থাকলে, এর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। জেনেটিক ফ্যাক্টর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কেমিক্যাল এক্সপোজার: কিছু কেমিক্যাল যেমন ক্যাডমিয়াম এবং নির্দিষ্ট হার্বিসাইড ও পেস্টিসাইড কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ: দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগ বা কিডনি ফেইলিওরের ফলে কিডনি ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বয়সভেদে কিডনি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা
কিডনি ক্যান্সার যে কোন বয়সের মানুষের হতে পারে, তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সে এর ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। বয়সভেদে কিডনি ক্যান্সারের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. শিশু ও কিশোর:
শিশু ও কিশোরদের মধ্যে কিডনি ক্যান্সার সাধারণত খুবই বিরল। তবে “উইলমস টিউমার” নামে একটি ক্যান্সার শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, যা মূলত ৩-৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
২. তরুণ বয়স (২০-৪০ বছর):
তরুণ বয়সে কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক ফ্যাক্টর বা পরিবারের ইতিহাস থাকলে এ বয়সের মানুষের মধ্যে কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
৩. মধ্যবয়সী (৪০-৬০ বছর):
মধ্যবয়সীদের মধ্যে কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ধূমপান, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগ এ বয়সে কিডনি ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হতে পারে।
৪. বয়স্ক (৬০ বছরের উপরে):
বয়স্ক মানুষের মধ্যে কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনির কার্যকারিতা কমে যায় এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যার ফলে কিডনি ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
কিডনি ক্যান্সার প্রতিরোধ এর উপায় গুলো কি কি?
কিছু সহজ অভ্যাস এবং জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমে কিডনি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখানে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
খাদ্য আমাদের স্বাস্থ্যের অন্যতম মূখ্য উপাদান। কিডনি ক্যান্সার প্রতিরোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা উচিত:
- প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া: শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা শরীরের কোষকে সুরক্ষা দেয় এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন: চর্বিযুক্ত প্রোটিন যেমন লাল মাংসের পরিবর্তে কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন যেমন মুরগি, মাছ, ডাল ইত্যাদি খাওয়া উচিত।
- প্রচুর পানি পান করা: পর্যাপ্ত পানি পান কিডনি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং টক্সিন বের করে দেয়।
প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করা: প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে চিনি, লবণ এবং কেমিক্যাল থাকে যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
২. ধূমপান ত্যাগ করা
ধূমপানে কিডনিতে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয় যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ধূমপান ত্যাগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত।
৪. নিয়মিত ব্যায়াম করা
নিয়মিত ব্যায়াম শরীরকে সুস্থ রাখে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা উচিত।
৫. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমানো উচিত।
৭. স্ট্রেস কমানো
অতিরিক্ত স্ট্রেস শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন এবং নিয়মিত বিশ্রাম স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
কিডনি ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান ত্যাগ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের কিডনিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই আমাদের সুরক্ষার চাবিকাঠি। তাই, আপনার স্বাস্থ্য রক্ষায় আজ থেকেই সচেতন হন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন।