ক্যান্সারের নাম শুনলে অনেকেরই গায়ে কাঁটা দেয়। এমন মরণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্যিই কঠিন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক উন্নত হয়েছে, তবে একজন ক্যান্সার রোগীর জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস অপরিহার্য। ক্যান্সার রোগীদের খাদ্য তালিকায় কী কী থাকা উচিত, তা এখানে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করবো।
ক্যান্সার চিকিৎসার সময় ডায়েট পরিবর্তন করা
ক্যান্সার রোগীদের প্রায়শই চিকিৎসার সময় খাবার খেতে সমস্যা হয়, এমনকি প্রিয় খাবারও খেতে কষ্ট হয়। এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনও ডায়েট শুরু করা সঠিক নয়। বরং আপনি যে খাবার খেতে পছন্দ করেন, সেগুলিই খান। অভ্যস্ত নয় এমন খাবার খাওয়ার চেয়ে পরিচিত খাবার খাওয়াই ভালো। তবে, পরিচিত খাবারের মধ্যেই পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নেওয়া উচিত।
আমিষ খাবার না নিরামিষ
আমিষ এবং নিরামিষ উভয় প্রকারের খাবারই খাওয়া যেতে পারে, তবে প্রোটিনের মাত্রা বজায় রাখতে হবে। আমিষ খাবারের মধ্যে ডিম, মুরগির মাংস এবং মাছ প্রোটিনের ভালো উৎস। নিরামিষ খাবারের মধ্যে মসুর ডাল, মটরশুটি, পনির এবং দুধ প্রোটিন সরবরাহ করে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত নিরামিষ খাবার ডায়েটে যোগ করা যেতে পারে।
ক্যান্সার রোগীদের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস
ক্যান্সার রোগীর জন্য খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাস রোগীর শরীরকে পুষ্টি জোগাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাবে। ক্যান্সার রোগীদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের পরামর্শ দেওয়া হল:
১. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার
প্রোটিন শরীরের টিস্যু পুনর্গঠন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ক্যান্সার রোগীদের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা বেশি। কিছু প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার:
ডিম: সেদ্ধ বা পোঁচ করে খাওয়া যায়। এটি সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর।
মুরগির মাংস: গ্রিলড বা সেদ্ধ করা মুরগির মাংস প্রোটিনের ভালো উৎস।
মাছ: ভাপা বা ঝোল করে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এতে প্রোটিন ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে।
মসুর ডাল এবং মটরশুটি: ডাল বা স্যুপ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। এটি নিরামিষ প্রোটিনের ভালো উৎস।
পনির এবং দুধ: চিজ বা মিল্কশেক হিসেবে খাওয়া যায়। এটি প্রোটিন এবং ক্যালসিয়ামের উৎস।
২. ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
ফাইবার হজম প্রক্রিয়া সঠিক রাখতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। কিছু ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার:
সবজি: পালং শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি ইত্যাদি।
ফল: আপেল, কমলালেবু, পেঁপে ইত্যাদি।
গোটা শস্য: ওটস, ব্রাউন রাইস, গমের রুটি ইত্যাদি।
৩. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কিছু অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার হচ্ছে:
বেরি জাতীয় ফল: ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি ইত্যাদি।
বাদাম এবং বীজ: আখরোট, বাদাম, সুর্যমুখী বীজ ইত্যাদি।
সবুজ শাকসবজি: পালং শাক, কেল ইত্যাদি।
৪. হাইড্রেশন
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপির পর। এছাড়া, তরল জাতীয় খাবারও খাওয়া উচিত:
পানি: প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত।
ফল বা সবজির রস: টাটকা ফলের রস বা সবজির জুস খাওয়া ভালো।
শরবত: লেবুর শরবত বা দইয়ের ঘোল পান করা যায়।
৫. সহজপাচ্য খাবার
ক্যান্সার রোগীদের জন্য সহজপাচ্য খাবার খাওয়া ভালো, যা হজমে সাহায্য করে এবং ক্লান্তি কমায়। কিছু সহজপাচ্য খাবার হচ্ছে:
খিচুড়ি: সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি হজমে সহজ এবং পুষ্টিকর।
পোলাও: সাদা ভাতের সাথে হালকা সবজি মিশিয়ে তৈরি পোলাও।
স্যুপ: সবজি বা মুরগির স্যুপ খাওয়া ভালো।
যেসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত
কিছু খাবার ক্যান্সার রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো বাড়াতে পারে। এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলা উচিত:
ময়দা দিয়ে তৈরি খাবার: যেমন, লুচি, পরোটা। এগুলোতে ফাইবারের অভাব থাকে।
ডিপ ফ্রাই করা খাবার: যেমন, ভাজা মাছে। এতে অতিরিক্ত তেল এবং ফ্যাট থাকে।
বেশি মশলাদার খাবার: মুখের আলসার বাড়াতে পারে।
মিষ্টি জাতীয় খাবার: যেমন কেক, পেস্ট্রি। এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়।
ক্যান্সার রোগী কোন বেলায় কি খাবে
এই খাদ্যতালিকা অনুসরণ করলে ক্যান্সার রোগীরা তাদের শরীরকে পুষ্টি জোগাতে এবং চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সক্ষম হবে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি বাড়াবে এবং রোগীর মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করবে। ক্যান্সার রোগীদের জন্য প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা কীভাবে হওয়া উচিত, তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা নিচে দেওয়া হল।
সকালের নাস্তা (Breakfast)
সকালের নাস্তা হতে হবে পুষ্টিকর এবং সহজপাচ্য, যাতে সারাদিনের জন্য পর্যাপ্ত শক্তি পাওয়া যায়।
দুধ ও কর্নফ্লেক্স: দুধে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং প্রোটিন থাকে। কর্নফ্লেক্সের সাথে মিশিয়ে খেলে এটি সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর।
ডিম সেদ্ধ: ডিমে উচ্চ প্রোটিন থাকে যা শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে।
ফল: তাজা ফল যেমন আপেল, কলা, কমলালেবু খেতে পারেন। এতে প্রচুর ভিটামিন এবং মিনারেল পাওয়া যায়।
দুপুরের খাবার (Lunch)
দুপুরের খাবার হওয়া উচিত যে সকল খাবারে শক্তি উৎপাদন করে। যেমন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার আছে এমন খাবার ।
ডাল ও ভাত: মসুর ডাল প্রোটিনের ভালো উৎস এবং ভাতে কার্বোহাইড্রেট থাকে যা শক্তি উৎপাদন করে।
সবজি: পালং শাক, মিষ্টি কুমড়া, বাঁধাকপি ইত্যাদি সবজি খাওয়া ভালো। এতে ফাইবার এবং ভিটামিন পাওয়া যায়।
মাছের ঝোল: মাছ প্রোটিন এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের ভালো উৎস। ঝোল করে খেলে সহজপাচ্য হয়।
বিকালের নাস্তা (Evening Snack)
বিকালের নাস্তা হতে হবে হালকা এবং পুষ্টিকর, যা ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করবে।
ফল ও বাদাম: তাজা ফলের সাথে কিছু বাদাম যেমন আখরোট বা আমন্ড খেতে পারেন। এতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট পাওয়া যায়।
দই: প্রোবায়োটিক এবং প্রোটিনের ভালো উৎস। এটি হজমে সাহায্য করে এবং পুষ্টি যোগায়।
রাতের খাবার (Dinner)
রাতের খাবার হতে হবে সহজপাচ্য এবং হালকা, যাতে রাতের ঘুম ভালো হয়।
রুটি ও সবজি: গমের রুটি এবং হালকা মশলাযুক্ত সবজি খাওয়া ভালো। এতে ফাইবার এবং ভিটামিন পাওয়া যায়।
সবজি স্যুপ: সবজি দিয়ে তৈরি স্যুপ হজমে সহজ এবং পুষ্টিকর।
ক্যান্সার রোগীদের জন্য সঠিক ডায়েট প্ল্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু শরীরকে পুষ্টি যোগায় না, বরং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তিও প্রদান করে। প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন, এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে খাদ্যাভ্যাসের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।